বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর চালানো গণহত্যার স্বীকৃতির দাবিতে জেনেভায় জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনে তোড়জোড় চালাচ্ছে বাংলাদেশ। এ উপলক্ষ্যে আয়োজিত ৯ দিনব্যাপি কর্মসূচি আজ সোমবার (৩ অক্টোবর) শেষ হচ্ছে। কমিশনের ২৫ নম্বর কক্ষে আলোচনা, প্রতিবাদ ও বাংলাদেশ জেনোসাইড বিষয়ক ভিডিও প্রদর্শনীরও আয়োজন করা হয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫১ বছর পর হলেও জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের ৫১তম সভার ৩ নং এজেন্ডায় ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশে সংঘটিত নৃশংস জেনোসাইডের বিষয়টি স্থান পায়। কমিশনের ৫১তম অধিবেশনে বাংলাদেশ জেনোসাইড ইস্যুটি নিয়ে জোরালো আলোচনার পরিবেশ তৈরির লক্ষ্যে আমরা একাত্তর, প্রজন্ম একাত্তর, ইউরোপিয়ান বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন (ইবিএফ) ও নেদারল্যান্ডসের প্রবাসী সংগঠন বাংলাদেশ সাপোর্ট গ্রুপ (বাসুগ) জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নয় দিনব্যাপি নানা কর্মসূচি গ্রহণ করে। এ উপলক্ষ্যে গত ২৫ সেপ্টেম্বর থেকে মানববন্ধন, বিক্ষোভ, সমাবেশ, আলোচনা, প্রদীপ প্রজ্জ্বলন, পোস্টার প্রদর্শন, জাতিসংঘভূক্ত দেশগুলোর বাংলাদেশ মিশনে স্মারকলিপি দেয়াসহ দেশ-বিদেশে নানা কর্মসূচি পরিচালিত হয়েছে।
বাংলাদেশের ময়মনসিংহ, নেত্রকোণা, জামালপুর, কিশোরগঞ্জ, শেরপুরের নালিতাবাড়ির বিধবা পল্লী, বরিশাল, দিনাজপুর, মানিকগঞ্জ, সিলেট ও মৌলভীবাজারে এসব কর্মসূচি আয়োজন করা হয়। নিউইয়র্ক, ইংল্যান্ড, টরোন্টো, সিডনি ও অস্ট্রেলিয়াতে মানববন্ধন, সমাবেশ ও আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এসব কর্মসূচি আয়োজনের অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা সংগঠন আমরা একত্তরের প্রধান সমন্বয়কারী হিলাল ফয়েজী বলেন, বাংলাদেশ জেনোসাইডের বিশ্ব স্বীকৃতি আদায়ে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম, উত্তরবঙ্গ জাদুঘর, আমরা একাত্তর, প্রজন্ম একাত্তর, ইউরোপিয়ান বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন (ইবিএফ) ও নেদারল্যান্ডসের প্রবাসী সংগঠন বাংলাদেশ সাপোর্ট গ্রুপ (বাসুগ) দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসছে।
এর আগে ২০২২ সালের জুলাই মাসে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের অধিবেশনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় সংঘটিত পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর জেনোসাইড নিয়ে আলোচ্যসূচি থাকলেও বাস্তব পরিস্থিতিতে সে আলোচনা ওই অধিবেশনে উত্থাপিত হতে পারেনি। বাসুগএই উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল। সেসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনে উপাচার্যের উপস্থিতিতে এবং পররাষ্ট্রপ্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম এমপি’র সক্রিয় অংশগ্রহণে জেনোসাইড বিষয়ক সভা অনুষ্ঠিত হয়।
হিলাল ফয়েজী বলেন, আমাদের দাবি আদায়ের পথে এসব কর্মসূচি আরেকটি ধাপ। জাতিসংঘের স্বীকৃতি নাপাওয়া পর্যন্ত এসব কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে। তিনি জানান,দাবি আদায়ের আন্দোলনে পররাষ্ট্র ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সক্রিয় সহযোগিতা করছে।
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বাংলাদেশ জেনোসাইডের আন্তর্জাতিক ও জাতিসংঘের স্বীকৃতি আদায়ে পররাষ্ট্র সচিবকে আহ্বায়ক করে সরকার এবং দেশ-বিদেশে আন্দোলনরত সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলোর সমন্বয়ে কমিটি করার পরামর্শ দেন।
তিনি বলেন, “এ দাবি আদায়ে সরকারকে এ্যাগ্রেসিভ ডিপ্লোমেসি এবং সমন্বিত ও সুচিন্তিত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের পক্ষেই এটি সম্ভব।”
তিনি বলেন, ২০১৭ সালে বাংলাদেশের পার্লামেন্টে ২৫ মার্চকে জাতীয় গলহত্যা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। কিন্তু আমরা জাতিসংঘের কাছে ২৫ মার্চ নয়, পুরো নয় মাসের গণহত্যার স্বীকৃতি চাই। এ স্বীকৃতি আদায় করতে হলে বাংলাদেশ জেনোসাইডের স্বীকৃতির দাবিতে প্রথমে জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলোর কাছে চিঠি দিতে হবে। তিনি সরকারকে প্রথম ভারতসহ বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর কাছে স্বীকৃতি চেয়ে আবেদন করার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, আগে আমাদের দাবির পক্ষে বিশ্ব জনমত তৈরি করতে হবে। তবেই এটা জাতিসংঘের স্বীকৃতি আদায়ের পথ প্রশস্ত করবে।
আগামী ৯ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক জেনোসাইড দিবস উপলক্ষ্যে একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির পক্ষ থেকে ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের সামনে সমাবেশ আয়োজন ও স্মারকলিপি দেয়া হবে বলে তিনি জানান।
সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের মহাসচিব সাংবাদিক হারুণ হাবীব বলেন, জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন জেনেভা কার্যালয়ে বাংলাদেশ জেনোসাইডের স্বীকৃতির দাবিতে আজকের আয়োজনের সুযোগটিকে আমরা একটা বড় অগ্রগতি বলে মনে করি। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ জেনোসাইডের আন্তর্জাতিক ও জাতিসংঘ স্বীকৃতিকে ত্বরান্বিত করতে আমাদের আরো কাজ করতে হবে। এজন্য দেশে ও বিদেশে এ বিষয়ে কর্মরত সকল সংগঠনকে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে, যাতে জাতিসংঘ যথাশিঘ্র আমাদের দাবিকে স্বীকৃতি দেয় এবং সুবিচার প্রাপ্তির পথ সুগম করে।
তিনি জানান, এ দাবির সমর্থনে সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম সারা দেশের বিভিন্ন জেলা ও মহানগরে সমাবেশ, সেমিনার, মোমবাতি প্রজ্জ্বলন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।
হারুণ হাবীব আরো জানান, জাতিসংঘের স্বীকৃতির দাবিতে আরো জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণ ও সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা তৈরির লক্ষ্যে সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম শিগগিরই সকল সংগঠনের অংশগ্রহণে একটি আলোচনার আয়োজন করতে যাচ্ছে।
সূত্র : বাসস
Leave a Reply