আজ ৪ঠা জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৮ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

ছবি: শহিদ কিশোর বীর মুক্তিযোদ্ধা এখলাছুর রহমান

স্মরণ: শহিদ কিশোর বীর মুক্তিযোদ্ধা এখলাছুর রহমান


মোজাম্মেল হক এরশাদঃ বাংলার স্বাধীকার আন্দোলনে নিবেদিত প্রাণ মুক্তিযুদ্ধের বৃহৎ অংশে রয়েছে স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ নাম শহিদ মুক্তিযোদ্ধা এখলাছুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে অসীম সাহসে বীর বিক্রমে বোয়ালখালী উপজেলার কধুরখীলের খোকার দোকান এলাকায় পাকবাহিনীর ওপর গ্রেনেড ছুঁড়ে মেরেছিলেন তিনি। এসময় তার সঙ্গে ছিল ব্যারিষ্টার মনোয়ার হোসেনের বড়ভাই সাইফুল ইসলাম। ওইদিন পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়েন এখলাছ। সেই সংগ্রামী বীর মুক্তিযোদ্ধা ৭১ সালের ৪ আগস্ট পাকবাহিনীর হাতে শহিদ হন। (তথ্য সূত্র দৈনিক পাকিস্তান, পূর্বদেশ, ইওেফাক ১৯৭১)।

এই কিশোর বীর মুক্তিযোদ্ধা ১৯৫৬ সালের মে মাসের ২০ তারিখে জন্মেছিলেন চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার পোপাদিয়া ইউনিয়নের আকুবদন্ডী গ্রামে মরহুম সৈয়দ জামাল উদ্দীন ও মরহুমা সৈয়দা মছুদা খাতুনের সন্তান।
অকুতোভয় বীরোচিত এই আত্মত্যাগী কিশোরের বীরত্বের ঐতিহাসিক ঘটনা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষণ করেছিলেন অলক দাশ গুপ্ত। তিনি জানিয়েছেন, স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রথম প্রহরে পাকিস্তানিদের পুড়িয়ে দেওয়া খোকার দোকানের খালি ভিটায় এই অগ্রণী যোদ্ধা এখলাছুর রহমান চরম সাহসিকতা নিয়ে বুট বাদাম বিক্রেতা সেজে শত্রুদের মোকাবেলার জন্য গ্রেনেড নিয়ে অপেক্ষায় ছিলেন। পাক আর্মি ও তাদের দোসররা কাছাকাছি আসলে এখলাছ গ্রেনেড চার্জ করেন। দূর্ভাগ্যবশত সেই গ্রেনেড পাশের ডোবাতে বিস্ফোরিত হয়। ওইসময় এলোপাতাড়ি গুলি চালাতে শুরু পাকবাহিনী। মুক্তিযোদ্ধা এখলাছ তখন দৌড়ে কচুরিপানায় ছেয়ে থাকা একটি পুকুরে আহত অবস্থায় আত্মগোপন করেন। তবে শেষ রক্ষা হয়নি, পাকিস্তানি আর্মিদের হাতে ধরা পড়েছিলেন তিনি। এরপর তার উপর পাশবিক নির্যাতন চালিয়েছে পাকবাহিনী। তাকে চাপসৃষ্টি করা হয় পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলতে, জবাবে এখলাছ আহত শরীরের থেকে নির্গত প্রবাহিত রক্ত দিয়ে মাটিতে লিখে দেন ‘জয়বাংলা’। এভাবে নির্যাতন করতে করতে তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে আলোচিত নাম ক্ষুদিরাম বসু, আর মহান মুক্তিযুদ্ধে সর্বাধিক আলোচিত বোয়ালখালীর প্রথম শহিদ কিশোর বীর মুক্তিযোদ্ধা এখলাছুর রহমান।

আরও পড়ুন ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা মোখতার আহমদের অবদান জাতি আজীবন শ্রদ্ধায় স্মরণ করবে’

স্বাধীনতা সংগ্রামের উজ্জ্বল নক্ষত্র শহীদ মুক্তিযোদ্ধা এখলাছুর রহমান ক্যাপ্টেন করিমের গড়া বাহিনী ও ৬৯এর ছাত্র মিছিলেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি কধুরখীল সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র ছিলেন। সরাসরি যুক্ত ছিলেন তৎকালীন প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে।
উল্লেখ্য, তৎকালীন স্যার আশুতোষ সরকারি কলেজের অধ্যাপক দিলীপ চৌধুরী গ্রুপের অন্যতম মুক্তিযোদ্ধা ও প্রবীন শিক্ষাবিদ রফিক আহমদ শহিদ এখলাছের ভগ্নিপতি। এছাড়াও বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিক আহমদ পটিয়া ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন। সাধারণ মানুষের উপর পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর নির্মমতা ও এদেশীয় সহযোগীদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে গ্রেনেড ছুড়ে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন এ সম্মুখ যোদ্ধা এখলাছুর রহমান। দেশ স্বাধীনের পর তাঁর স্মৃতি বিজড়িত বিদ্যাপীঠ কধুরখীল উচ্চ বিদ্যালয় মিলনায়তনকে নামকরণ করা হয় শহিদ বীর মুক্তিযোদ্ধা এখলাছ মিলনায়তন। ইকবাল পার্কের নাম পরিবর্তন এনে করা হয়েছিল শহিদ মুক্তিযোদ্ধা এখলাছ পার্ক। এছাড়া একটি সড়কের নামকরণও করা হয় এই মহান বীরের নামে।
তবে স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী অতিক্রান্ত হলেও এই শহিদের জননী তার সন্তানের স্বীকৃতি না পাওয়ার যন্ত্রণা বুকে নিয়ে পরপারে চলে গিয়েছেন। লাল মুক্তিবার্তায় নাম থাকলেও এই বীরের গর্বিত পরিবারকে শহিদ গেজেটে নাম অন্তর্ভুক্তির জন্য অপেক্ষায় থাকতে হয় দীর্ঘসময়। প্রয়াত সাংসদ মরহুম মঈন উদ্দিন খান বাদল ও মোসলেম উদ্দিনের সুপারিশ ক্রমে, ২০২০ সালের ৭ অক্টোবর জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলে ভাগিনা মোজাম্মেল হক এরশাদের সরকারিভাবে গেজেট অন্তর্ভুক্তির জন্য সাক্ষাৎকারের পর ২০২১ সালের ২৭ জুন বেসামরিক শহিদ গেজেটেড করা হয় তাঁকে। সকল প্রকার কার্যক্রম সম্পন্ন হলেও আজও অদৃশ্য জটিলতা ও টানাপোড়ন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কিছুদিন পূর্বে বর্তমান সাংসদ নোমান আল মাহমুদ শহিদ এখলাছ সড়কের সংস্কার কাজ উদ্বোধন করেছেন। ১৯৯৭ সালে মুক্তিযোদ্ধা কেন্দ্রীয় কমান্ড কতৃক শনাক্ত করা হয়েছিল মুক্তি/ কবর/বো-১১৮ তবে আজো দৃশ্যমান হয়নি তা। এতে প্রমাণ হয়, রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের উদাসীনতা, জাতীয় বীর শহিদের প্রতি অশ্রদ্ধা! ইতিহাসের বৃহৎ অংশে বোয়ালখালী উপজেলা সদরের স্মৃতিসৌধে এ মহান বীর শহিদের নাম রয়েছে, কাজেই দেশমাতৃকার অতুলনীয় আত্মত্যাগের জন্য লাল সবুজের পতাকা জুড়ে ও স্মৃতির দর্পনে চির উজ্জ্বল হয়ে থাকবেন এই শহিদ কিশোর বীর মুক্তিযোদ্ধা এখলাছুর রহমান।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     এই বিভাগের আরও খবর