আজ ১৪ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৭শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

রেল যেভাবে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে


মাহবুব কবীর মিলন

প্লেন, বাস এবং লঞ্চ নিয়ে কিন্তু মানুষের ততটা আবেগ নেই, যতটা কাজ করে রেলের ক্ষেত্রে। সেই ছোটবেলার কুউউ…ঝিক-ঝিক মনের মধ্যে আন্দোলিত হতে থাকে আমাদের জীবনভর। এজন্যই রেলের উন্নয়ন নিয়ে মানুষের এত দাবি, এত চাওয়া-পাওয়া।

আমাদের রেল চলছে সেই ব্রিটিশ আমলের আইন দ্বারা। ১৮৯০ সালের আইন এখনো যুগোপযোগী করে সাধারণ মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হিসেবে আলোর মুখ দেখেনি। কাজ চলছে, তবে তা শেষ করা দরকার অতি দ্রুত।

বাংলাদেশ রেলওয়ে। সর্বাধিক যাত্রী সেবাদানকারী আলোচিত এক প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম, টিকেট কালোবাজারি, অব্যবস্থাপনা নিয়ে কথা হচ্ছে অনেকদিন ধরে। প্রতিটি ক্ষেত্রে যাত্রী কল্যাণ বৃদ্ধির দাবি উঠছে। যাত্রীদের এসব চাওয়া অমূলক নয়, এই চাওয়া রেলের প্রতি মানুষের আস্থা এবং ভালোবাসার প্রতীক হিসেবেই বিবেচ্য।

রেলে কর্মরত অবস্থায় বেশ কয়েকটি কল্যাণমূলক প্রস্তাব দিয়েছিলাম। তার মধ্যে টিকিট কালোবাজারি দূর করার লক্ষ্যে ‘টিকিট যার ভ্রমণ তার’ নীতি বাস্তবায়নের কাজ বর্তমানে অনেকদূর এগিয়ে নিয়েছে রেল।

আশা করা যায়, অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তা বাস্তবায়ন হবে। আর এটি হলে যাত্রী কল্যাণে তা হবে এক মাইলফলক। কালোবাজারির অভিশাপ একেবারেই দূর হয়ে যাবে বলে আশা করা যায়।

এছাড়াও যে পদক্ষেপগুলো জরুরি গ্রহণ করা প্রয়োজন, তাহলো, টিকিট বাতিলের ক্ষেত্রে অনলাইন রিফান্ড ব্যবস্থা চালু। যাত্রী সেবা উন্নয়নে একটি আধুনিক কল সেন্টার চালু করা প্রয়োজন।

স্ট্যান্ডিং যাত্রীর জন্য কিছু কোচকে স্ট্যান্ডিং কোচে রূপান্তর। রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীকে রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনী আইন অনুযায়ী একটি শক্তিশালী এবং আধুনিক বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলা জরুরি।

রেলে আলাদাভাবে কয়েকজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সংযুক্ত করা হলে তারা র‍্যাব, পুলিশ, এপিবিএন, আরএনবি’র-এর সহায়তায় সার্বক্ষণিক কাজ করতে পারবেন মাঠ পর্যায়ে।

ঈদ বা যেকোনো উৎসবের সময় স্টেশনে দায়িত্ব পালন করলে, বিশেষ করে কমলাপুর, বিমানবন্দর এবং জয়দেবপুর স্টেশনে টিকিট ছাড়া কোনো যাত্রী যেন স্টেশনে প্রবেশ করতে না পারে এবং বিশেষ করে বিনা টিকিটের যাত্রী রোধসহ ট্রেনের ছাদে যাত্রী ওঠা অবশ্যই বন্ধ করে দেওয়া সম্ভব।

এই বিষয়ে অবশ্য মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগ আদেশ দিয়েছেন। আদালত বলেছেন, ‘এরপর থেকে ট্রেনের ছাদে কোনো যাত্রী পরিবহন করলে দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ ২১ জুলাই ২০২২, বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি খিজির হায়াতের হাইকোর্ট বেঞ্চ মৌখিকভাবে এই আদেশ দেন (ঢাকা পোস্ট, ২১ জুলাই ২০২২)।

মহামান্য হাইকোর্টের এই নির্দেশনার প্রেক্ষিতে ট্রেনের ছাদে ও ইঞ্জিনে অবৈধ যাত্রী ওঠা বন্ধে রেল লাইনের ওপর লোহার বার স্থাপনসহ রেল যেকোনো কঠিন সিদ্ধান্ত এখন অনায়াসেই নিতে পারে।

একজন টিকিটধারী যাত্রী টিকিট কেটে অবৈধ যাত্রী চাপে ট্রেনে উঠতে না পারলে বা উঠে সিট না পেলে, তার দায় রেলের উপরেই বর্তায়। ঈদের সময় রেল যাত্রায় ঢাকা-গাজীপুর ছাড়া যাত্রীদের কত শতাংশ বিনা টিকিটে রেলের ছাদে বা ইঞ্জিনে বা বগিতে দাঁড়িয়ে এলাকা ছাড়ে সেই হিসেব আমরা মোটামুটি সবাই জানি।

সর্বোচ্চ ১ শতাংশ বা তারও কম। এই ছাদ, ইঞ্জিন এবং ভেতরে অবৈধ যাত্রী হয়ে যাওয়া সামান্য অংশ মোট বাড়ি যাওয়া মানুষকে রিপ্রেজেন্ট করে না কখনোই।

কাজেই এদের জন্য পুরো সিস্টেমকে ম্যাসাকার বা ধ্বংস হতে দেওয়ার কোনো অবকাশ বা সুযোগ নেই। এটা যেকোনো উপায়ে রোধ করা প্রয়োজন। এদের আসল উদ্দেশ্য বিনা খরচে যাওয়া। তাছাড়া রেল বাধ্য নয় যেকোনো উপায়ে সকল যাত্রীকে বাড়ি-বাড়ি পৌঁছে দেবে। এটা আশা করাও বোকামি।

কোনো একটি ট্রেন লাইনচ্যুত বা দুর্ঘটনায় পড়ে লাইন বন্ধ হয়ে গেলে অন্যান্য অনেক ট্রেন বাতিল হয়ে যায়। অনেক ট্রেন পথে বসে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। অনেক যাত্রী স্টেশন গিয়ে বাড়ি ফিরে আসেন। তারা স্টেশন গিয়ে জানতে পারেন, ট্রেন বাতিল করা হয়েছে। এতে করে নারী, শিশু, বয়স্কসহ হাজার হাজার যাত্রী ভয়াবহ বিড়ম্বনায় পড়ে যান।

যাত্রী কল্যাণে এসব সিদ্ধান্ত বহুল প্রচারের ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। একটি কল সেন্টার চালু করা খুব জরুরি। যেখান থেকে একটি কল করে যাত্রী তার প্রয়োজনীয় তথ্য জেনে নিতে পারেন। কল সেন্টার করার জন্য রেলওয়ে বিটিআরসি থেকে একটা শর্ট কোড নম্বর নিয়েছিল বহু বছর আগে।

সারাদেশ ডিজিটাল করার জন্য সরকার আপ্রাণ কাজ করে যাচ্ছে। এর অর্থ হলো, যেকোনো পর্যায়ে সেবা যেন ডিজিটালি গ্রাহক পর্যায়ে পৌঁছে। পূর্বে নিয়ম ছিল নিজে ভ্রমণ করলে অনলাইন প্রিন্ট কপি দিয়েই ভ্রমণ করা যেত। এখন অনলাইন প্রিন্ট কপি আবার কাউন্টার থেকে প্রিন্ট করে নিতে হয়। যা ডিজিটাল সেবার ব্যত্যয়।

রেলের অনিয়ম এবং টিকিট নিয়ে যাত্রীদের নানা ধরনের ক্ষোভ ও অভিযোগ বিরাজ করছে। আন্তরিকতার সাথে এসব সমস্যার অবশ্যই সমাধান সম্ভব। তবে আশার কথা হচ্ছে, বেশকিছু ভালো কাজ হাতে নিয়েছে রেল। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে রেলের ইঞ্জিনে ফুয়েল ট্র্যাকার বসানো।

প্রায় ১০০টি লোকোতে তা ইন্সটল করা হয়েছে। তেল চুরি বন্ধে এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। ট্র্যাকারের মাধ্যমে রিমোটলি লোকোর তেল ব্যবহার মনিটর করা যায় যেকোনো ডিভাইস থেকে। এর ফলে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ক্ষতি থেকে বেঁচে গিয়েছে রেল। সব লোকোতে ট্র্যাকার স্থাপন করা হলে তেল চুরি একেবারেই বন্ধ হয়ে যাবে।

বিভিন্ন আনম্যান্ড অরক্ষিত লেভেল ক্রসিং এই অটোমেটেড কম্পিউটারাইজড আধুনিক পদ্ধতির গেট বসানোর কাজ ট্র্যায়াল পর্যায়ে রয়েছে। এই প্রকল্প দুর্ঘটনার হার অনেকাংশে কমিয়ে আনবে। গতি বাড়িয়ে দেবে রেলের।

সম্মুখ দুর্ঘটনা রোধে হাতে নেওয়া হয়েছে এন্টি ফ্রন্ট কলিশন ডিভাইস স্থাপনের কাজ। এটি করা হলে রেলের সম্মুখ দুর্ঘটনা একেবারেই বন্ধ হয়ে যাবে।

আমি আশাবাদী, আগামী এক বছরে মধ্যে রেলের প্রভূত উন্নয়ন দেখতে পারব আমরা।

মাহবুব কবীর মিলন ।। অতিরিক্ত সচিব (পিআরএল) ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ইভ্যালি


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     এই বিভাগের আরও খবর