#অবৈধ প্রক্রিয়ায় বেদখল ভরাট হচ্ছে অধিকাংশ
#প্রাকৃতিক ব্যবস্থাপনার উপাদান কমে বাড়ছে বিপদ
#বর্তমানে আছে কতটি জানে না কোনো সংস্থা
#সঠিক সংখ্যা জানতে ও সংরক্ষণে সার্ভে করছে সিডিএ
নিজস্ব প্রতিবেদক
চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলায় সম্প্রতি অভিযান চালিয়ে অবৈধ দখলে থাকা ৮ একর ভূমির ৬টি সরকারি খাস খতিয়ানভুক্ত পুকুর উদ্ধার করেছে উপজেলা প্রশাসন। স্থানীয় প্রভাবশালী একটি মহল জলাশয়গুলো অবৈধ প্রক্রিয়ায় দখল করে রেখেছিলো। জুলধা ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের আশ্রয়ণ প্রকল্প সংলগ্ন এলাকা থেকে পুকুর গুলো উদ্ধার করা হয়।
কর্ণফুলী উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পিযুষ কুমার চৌধুরী বলেছেন, ‘৮ একর পরিমাণের ৬টি সরকারি খাস খতিয়ানভুক্ত পুকুরের বর্তমান মূল্য প্রায় ৪০ কোটি টাকা। এ জমির আসল মালিক সরকার। বর্তমানে এসব পুকুর উদ্ধার করে সরকারিভাবে মাছের পোনা অবমুক্ত করা হয়েছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘এ ৬টি পুকুর ‘কর্ণফুলী উপজেলায় সাঁতার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র’ হিসেবে ব্যবহার করা হবে। এছাড়া পুকুরের পাড় এলাকার সকল মানুষের চিত্ত বিনোদন, হাঁটাহাঁটি ও সুস্থ্যতার জন্য উন্মুক্ত থাকবে।’
উপরের ঘটনাটি ছিলো চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলার। সরকারি খাস ভূমি হওয়ায় ভূমি কর্মকর্তা ও স্থানীয় প্রশাসনের তৎপরতায় সেগুলো উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। যদি সঠিক সময়ে পুকুরগুলি উদ্ধার না হতো তাহলে হয়ত চট্টগ্রামের মতই পরিস্থিতি হতো। এভাবে কখনও নীতি নির্ধারণী সংস্থার নাকের ডগায় উন্নয়ন প্রকল্পের আড়ালে আবার কখনও আইনী ফাঁক ফোকরে চট্টগ্রাম থেকে উধাও হয়ে গেছে হাজার হাজার জলাশয়-পুকুর। এর প্রভাব পড়েছে নগরীর জলাবদ্ধতায় এবং আশঙ্কা বাড়ছে বন্যার।
ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি) এর মতে, বিগত দশকগুলোতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে উন্নয়নকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে বন্যাসহ বিভিন্ন দুর্যোগ মোকাবিলার প্রাকৃতিক ব্যবস্থাপনার উপাদানগুলো নষ্ট করে বিপদ ডেকে আনা হয়েছে। তাই সারা দেশেই দীর্ঘস্থায়ী বন্যার আশঙ্কা করা হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আগামী বছরগুলোতেও নিয়মিতভাবে এ ধরনের বন্যা দেখা দিতে পারে।
আগামী দিনে প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে বাঁচতে হাওর-বাঁওর, নদী-খাল, জলাশয়-জলাভূমি প্রভৃতি প্রাকৃতিক জল ধারণ এলাকা সংরক্ষণের বিকল্প নেই বলে মনে করে আইপিডি। এ জন্য জলাশয় দখল-ভরাটের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনার আহ্বান জানিয়েছে সংগঠনটি। আইপিডির অভিযোগ, বন্যা উপদ্রুত এলাকায় সরকারের তরফ থেকে যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ হয়েছে, তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। বন্যাদুর্গতদের উদ্ধার-আশ্রয় ও পুনর্বাসনে সমন্বিত কার্যক্রম আরো জোরদারের আহ্বান জানিয়েছে সংস্থাটি।
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কতৃপক্ষের (সিডিএ) একটি নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, ২০০৮ সালে সংস্থাটি চট্টগ্রাম নিয়ে ডিটেইলড এরিয়াপ্ল্যান (ড্যাপ) তৈরি করেছিলো। প্রায় ১৫ বছর পূর্বে তৈরি করা সেই প্ল্যানের কিছু সার্ভেতে উঠে এসেছিলো পুকুর-জলাশয়ের বিষয়টি। কিন্তু তৎকালেও কয়টি পুকুর-জলাশয় ছিলো তার সঠিক তথ্য যেমন ছিলোনা তেমনি বর্তমানেও তার নিশ্চিত তথ্য নেই সংস্থাটির কাছে।
এ প্রসঙ্গে আলাপকালে সিডিএ’র নগর পরিকল্পনাবিদ মো. আবু ঈসা আনছারী চাটগাঁর সংবাদকে বলেন, ‘বর্তমানে চট্টগ্রামে কতটি পুকুর বা জলাশয় রয়েছে তার সঠিক সংখ্যা আমাদের জানা নেই, এ সম্পর্কে ভাসা ভাসা কিছু তথ্য আছে; যা অথেন্টিক না। বিএস জরিপে থেকে যে তথ্য পাওয়া যায় সে তথ্যই আমাদের কাছে আছে। এছাড়া ২০০৮ সালে সিডিএ’র মাস্টারপ্ল্যানে কিছু তথ্য যোগ হয়েছে সেটা পুরোপুরি সঠিকও বলা যাচ্ছে না।’
তবে ২০২১ সালে শুরু হওয়া সিডিএ’র চলমান মাস্টারপ্ল্যানটিতে পুকুর-জলাশয় নিয়ে সার্ভে হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, ‘কয়েক মাসের মধ্যে পুকুর-জলাশয়ের সঠিক সংখ্যা আমরা জানাতে পারব।’
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের দেয়া তথ্যানুযায়ী, পুরো জেলায় সরকারি খাসভুক্ত যে কয়টি পুকুর-জলাশয় রয়েছে সে তথ্য সংস্থাটির কাছে আছে, সার্বিক তথ্য তাদের কাছে নেই। বর্তমানে নয়টি পুকুর বা জলমহাল সংস্থাটি বাৎসরিক ইজারা দেয়।
এ প্রসঙ্গে আলাপকালে চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মাসুদ কামাল চাটগাঁর সংবাদকে বলেন, ‘বর্তমানে পুরো জেলায় কতটি পুকুর-জলাশয় রয়েছে তার সঠিক তথ্য আমাদের কাছে নেই, তবে সরকারি খাসভুক্ত জলমহালগুলোর তথ্য আছে। যেগুলো বর্তমানে ইজারা দেয়া হয় এর বাইওে আরো জলমহাল থাকতে পারে তাই তথ্যগুলো হালনাগাদ করার কাজ চলমান রয়েছে।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৯৮১ সালে পরিবেশ অধিদপ্তর এ বিষয়ে একটি সার্ভে করেছিলো। ১৯৯১ সালে মৎস্য অধিদপ্তরের এক জরিপে ১৯ হাজার ২৫০টি পুকুর-জলাশয়ের কথা উল্লেখ করা হয়।
মূলত জমির মূল্য অস্বাভাবিক বাড়ার কারণে নব্বইয়ের দশক থেকে চট্টগ্রামে পুকুর-জলাশয় ভরাটের মহোৎসব শুরু হয়। রাতারাতি পুকুর ভরাট করে তৈরি হয়েছে অগণিত স্থাপনা।
চট্টগ্রাম পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক (উপসচিব) হিল্লোল বিশ্বাস এ প্রসঙ্গে চাটগাঁর সংবাদকে বলেন, ‘পুকুর বা জলাশয় রক্ষায় জেলা প্রশাসন, সিডিএ এবং পরিবেশ অধিদপ্তর আইন প্রয়োগ করতে পারে। যেটুকু জলাশয় বা পুকুর বর্তমানে রয়েছে, আমরা আমাদের যথাসাধ্য চেষ্টা করছি সেগুলো রক্ষা করার। যদি কোনো ইনফোরমেশন পায় সেক্ষেত্রে আমরা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিয়ে থাকি।’
প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইনানুযায়ী, কোনো পুকুর-জলাশয়, নদী-খাল ভরাট করা বেআইনি। সরকারি জলমহাল সংরক্ষণে ২০০৯ সালে একটি আইন প্রণয়ন করা হয়েছিলো। এছাড়া বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-২০১০ অনুযায়ী, ‘জাতীয় অপরিহার্য স্বার্থ ছাড়া কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সরকারি-আধাসরকারি স্বায়ত্ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিমালিকানাধীন পুকুর বা জলাধার ভরাট করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। তবে এই আইনটি কেবল মহানগরী, বিভাগীয় শহর ও জেলা শহরের পৌর এলাকার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এই আইনে উল্লেখ আছে, ‘বিধান লঙ্ঘন করিলে অনধিক ৫ বৎসরের কারাদণ্ডে বা অনধিক ৫০ (পঞ্চাশ) হাজার টাকা অর্থদণ্ডে অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন।’
Leave a Reply