চাটগাঁর সংবাদ ডেস্ক
দেশের পোলট্রি খামারগুলোতে দিন দিন বাড়ছে অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার। সঙ্গত কারণেই খামারের প্রাণীদের মধ্যে বেড়ে যাচ্ছে ওষুধ প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া। এরপর এগুলো মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর খাদ্যশৃঙ্খলে প্রবেশ করছে। এর মাধ্যমে মানুষের দেহেও বাসা বাঁধছে ওষুধ প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া; স্বাস্থ্যঝুঁকি মারাত্মকভাবে বেড়ে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে এক ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখে পড়তে হবে পুরো মানবজাতিকেই। সম্প্রতি বাংলাদেশ কৃষি বিশ^বিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের করা এক গবেষণায় উঠে এসেছে এমন ভয়ঙ্কর তথ্য।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পোলট্রি ড্রাগ ও ফিড বিক্রেতারা পশু চিকিৎসকের গাইডলাইন না মেনে তুচ্ছাতিতুচ্ছ কারণেও খামারিদের কাছে বিক্রি করছেন অ্যান্টিবায়োটিক। অধিকাংশ খামারিই অ্যান্টিবায়োটিকের উইথড্রয়াল পিরিয়ড সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন। খামার-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জরুরি মুহূর্তে চিকিৎসক না মিললেও ফিড দোকানে পাওয়া যায় ওষুধ। এছাড়া ফিড ও ড্রাগ ব্যবসায়ীদের বিজ্ঞাপনের ফাঁদে পড়েও অনেক খামারি যখন-তখন ব্যবহার করছেন অ্যান্টিবায়োটিক।
বাংলাদেশের ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, শেরপুর ও জামালপুরের প্রান্তিক পোলট্রি খামারি এবং ফিড বিক্রেতাদের ওপর চালানো ওই গবেষণায় দেখা যায়, ৭০ শতাংশ ফিড ব্যবসায়ী অ্যান্টিবায়োটিক সম্পর্কে জানেন যাদের মধ্যে ৭৫ শতাংশ ওষুধ প্রতিরোধী জীবাণু সম্পর্কে ধারণা রাখেন। অ্যান্টিবায়োটিকের মেয়াদকাল সম্পর্কে জানেন ৫০ শতাংশ অপেশাদার পরামর্শদাতা। এসব ক্ষেত্রে ৯০ শতাংশ পরামর্শদাতা মানেন না পশু চিকিৎসকদের গাইডলাইন। তবে এদের মাঝে ৮০ শতাংশের দাবি তারা গাইডলাইন মেনে অ্যান্টিবায়োটিকের পরামর্শ দেন। এদের মাঝে ৪৫ শতাংশ বিক্রেতা একই সময়ে একটি মাত্র অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের পরামর্শ দেন; যেখানে ৫৫ শতাংশ একই সময়ে একাধিক অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারেরর পরামর্শ দিয়ে থাকেন। ১৫ শতাংশ মাসে একবার অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের পরামর্শ দিলেও ৮৫ শতাংশ যথেচ্ছ ব্যবহারের পরামর্শ দিচ্ছেন।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকলোজি বিভাগের অধ্যাপক ড. কাজী রফিকুল ইসলাম গবেষণা সম্পর্কে বলেন, ‘আমরা দেখেছি প্রান্তিক পর্যায়ে অদক্ষ অনেক পশু চিকিৎসক আছেন। এছাড়াও ফিড কোম্পানিগুলোর যেসব পশু চিকিৎসক মাঠপর্যায়ে কাজ করে তারাও অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার করছে। এমনকি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারা অ্যান্টিবায়েটিক প্রয়োগের সঠিক নিয়ম মানছেন না। এতে করে সৃষ্টি হচ্ছে ওষুধ প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া।’
এদিকে খামারিরা বলছেন, সচেতনতার অভাবে অধিকাংশ পোলট্রি খামারে অ্যান্টিবায়োটিকের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার বাড়ছে। দেশের পোলট্রি খাতের সিংহভাগজুড়ে আছেন প্রান্তিক খামারিরা। তারা বলছেন, এর পিছনে দায়ী ফিড বিক্রেতাদের আগ্রাসী বিপণন মনোভাব।
প্রান্তিক খামারিদের সংগঠন বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুমন হাওলাদার বলেন, ‘গ্রামপর্যায়ে যেখানে ডাক্তার থাকার কথা ছিল সেখানে ডাক্তার পাওয়া যায় না। তবে ফিড কোম্পানির লোকরা নিয়মিত খামারিদের সাথে যোগাযোগ রাখেন। তারা খামারিদের বোঝায় এ ধরনের ওষুধগুলোকে মুরগির গ্রোথ বাড়াবে এবং সুস্থ রাখবে। অসচেতন খামারিরা এই ফাঁদে পড়ে মাত্রাতিরিক্ত অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের দিকে ঝুঁকছেন।’
পোলট্রি খামারে অ্যান্টিবায়োটিকের অনিয়ন্ত্রিত এমন ব্যবহার বাড়াচ্ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রাণিদেহে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অ্যান্টিবায়োটিক কার্যকর থাকে। প্রান্তিক খামারিরা এ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল না হয়েই অ্যান্টিবায়োটিক চলাকালীন মুরগি বাজারে বিক্রি করে থাকেন। যার ফলে খাদ্যের মাধ্যমে ওষুধ প্রতিরোধী এসব জীবাণু প্রবেশ করছে মানব শরীরে। মানবদেহে অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে যে জীবাণু বৃদ্ধি পাচ্ছে, তা কতটা গভীরে এবং কী ধরনের পরিবর্তন ঘটাচ্ছেÑ তা দেখতে এর আগে রাজধানী ঢাকাসহ সাত বিভাগের ১২টি হাসপাতালের রোগীদের ওপর গবেষণা চালিয়েছে সরকারের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেল সেন্টার (এনআইএলএমআরসি)। এসব হাসপাতালে আসা ১৩ হাজার ৩৫০ জনের নমুনা সংগ্রহ করা হয়। সাধারণ অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী (মাল্টিড্রাগ) এবং সব ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী (প্যানড্রাগ) রোগী প্রায় ৯ শতাংশ। ২০২২ সালের অক্টোবর থেকে চলতি বছরের মে পর্যন্ত আট মাস ব্যাপ্তির এ গবেষণায় ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধী ২৮টি জিন পাওয়া গেছে। নতুন এসব জিন বিভিন্ন ধরনের অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে নিজেদের শক্তি বাড়াচ্ছে, যা খুবই উদ্বেগের, বলছেন গবেষকরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতর গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বিজ্ঞানী লতিফুল বারী বলেন, ‘বাংলাদেশে আইন করে মুরগির ফিডে অ্যান্টিবায়োটিক হরমোন ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হলেও আমরা টেস্ট করে এখনও অ্যান্টিবায়োটিকের উপস্থিতি লক্ষ করি। এর কারণ ফিড তৈরিতে ব্যবহার করা হয় নিম্নমানের দ্রব্য। যেগুলো অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করলে দীর্ঘদিন ভালো রাখা যায়। বিশেষ করে খামারিরা মুরগি বিক্রির আগে বেশি লাভের আশায় বেশি করে ফিড খাওয়ায়। ফিডে থাকা অ্যান্টিবায়োটিক এবং খামারে ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করা অ্যান্টিবায়োটিক প্রবেশ করছে মানব শরীরে। এভাবে ছড়িয়ে পড়ছে ওষুধ প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া।’
সার্বিক বিষয়ে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) ডা. মোহাম্মদ রেয়াজুল হক বলেন, ‘যে প্রাণীটিকে খেতে হবে তাকে অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ানো যাবে না। তাছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করলে মুরগির গ্রোথ বাড়ে না বরং কমে যায়। এটা মানুষকে জানাতে হবে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের উদ্যোগে অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার রোধে সচেতনতা ক্যাম্পেইন চালু আছে। আমরা একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ে উঠোন বৈঠক করেও মানুষকে সচেতন করছি। অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার শুধু কমানো না, আমরা জিরোতে আনার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’ তথ্যসূত্র: আমাদের সময়
Leave a Reply