
আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে বিএনপি ঘোষণা দিয়েছে ২৩৭ আসনে একক প্রার্থী। এই আগাম ঘোষণার ফলে দলীয় প্রস্তুতি ও মাঠপর্যায়ের তৎপরতা বাড়বে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। পাশাপাশি ধারণা করা হচ্ছে, এতে মনোনয়ন ঘিরে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বও কিছুটা প্রশমিত হবে। এবারের তালিকায় নবীন ও প্রবীণের মধ্যে ভারসাম্য রাখার চেষ্টা দেখা গেছে। একই পরিবারের একাধিক আগ্রহী থাকলেও দলীয় নীতিতে কেবল একজনকেই বাছাই করা হয়েছে—যা দলের ভেতরে প্রশংসা কুড়াচ্ছে।
তবে এই ঘোষণায় সবচেয়ে আলোচনায় এসেছে দুই ত্যাগী নেতার নাম বাদ পড়া—বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী ও যুগ্ম মহাসচিব হাবিব উন নবী খান সোহেল। দলের কঠিন সময়ের পরীক্ষিত এই দুই নেতা ধানের শীষের প্রার্থী তালিকায় না থাকায় তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। ফেসবুকে অনেক নেতাকর্মীই প্রশ্ন তুলেছেন—দলের জন্য এত ত্যাগের পরও যদি মনোনয়ন না মেলে, তবে যোগ্যতার সংজ্ঞা কী?
রিজভীর অনুপস্থিতি নিয়ে বিস্ময়
বিএনপির মুখপাত্র হিসেবে বরাবরই সামনের সারিতে ছিলেন রুহুল কবির রিজভী। দীর্ঘদিন ধরে তিনি ছিলেন দলের আন্দোলন-সংগ্রামের প্রতীক। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদলের নেতৃত্ব থেকে উঠে এসে কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে নিজের জায়গা পোক্ত করেন তিনি।
তার জন্মভূমি কুড়িগ্রাম ও রাজনৈতিক ঘাঁটি রাজশাহীতে অনেকেই নিশ্চিত ছিলেন—এবার অন্তত একটি আসনে রিজভী ধানের শীষ পাবেন। কিন্তু ঘোষিত তালিকায় তার নাম না থাকায় হতাশা নেমেছে কর্মীদের মধ্যে।
রিজভী ছিলেন এমন এক নেতা, যিনি বিএনপির কার্যালয় পুলিশবেষ্টিত থাকলেও সেখান থেকেই কর্মসূচি চালিয়ে গেছেন। ১৮০টিরও বেশি মামলার আসামি এই নেতা একাধিকবার জেলে গেছেন, রিমান্ডে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, অসুস্থ অবস্থাতেও দলীয় দায়িত্ব পালন করেছেন। এত ত্যাগের পরও তার নাম প্রার্থী তালিকায় না থাকা অনেকের কাছেই বেদনাদায়ক।
দলীয় সূত্র বলছে, এটি এখনো প্রাথমিক তালিকা; প্রয়োজনে পরিবর্তনের সুযোগ রয়েছে। তবে রিজভী নিজে কিংবা তার ঘনিষ্ঠরা এখনো আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিক্রিয়া দেননি।
সবচেয়ে বেশি মামলার আসামি সোহেলও বঞ্চিত
অন্যদিকে বিএনপির আরেক ‘মাঠের সেনানায়ক’ হাবিব উন নবী খান সোহেলও এবার মনোনয়ন পাননি। ফ্যাসিবাদের সময় মাঠে থেকে যে কজন নেতা অবিচল ছিলেন, তাদের মধ্যে সোহেল অন্যতম। ছাত্রদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সভাপতি এই নেতা বর্তমানে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব পদে রয়েছেন।
দলীয় সূত্র অনুযায়ী, তার বিরুদ্ধে সারাদেশে প্রায় সাড়ে চার শতাধিক মামলা রয়েছে—যা তাকে বিএনপির মধ্যে সবচেয়ে বেশি মামলার আসামি হিসেবে পরিচিত করেছে। প্রায় প্রতিদিনই তাকে কোনো না কোনো আদালতে হাজিরা দিতে হয়। তবুও তিনি দলীয় কর্মসূচিতে সক্রিয় থেকেছেন।
ঢাকা-৮ বা ঢাকা-৯ আসনে তার মনোনয়ন প্রত্যাশা করছিলেন সমর্থকরা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঐ আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস। এই সিদ্ধান্তে হতাশ হলেও সোহেল দলের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছেন বলে ঘনিষ্ঠ সূত্র জানিয়েছে।
তৃণমূল নেতাকর্মীদের মতে, ত্যাগী ও নির্যাতিত নেতাদের মূল্যায়ন না হওয়া দলের জন্য নেতিবাচক বার্তা বয়ে আনতে পারে।
আরও যারা বাদ
এই তালিকায় শুধু রিজভী ও সোহেলই নন, বাদ পড়েছেন আরও কয়েকজন কেন্দ্রীয় হেভিওয়েট নেতা। স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার, নজরুল ইসলাম খান ও সেলিমা রহমানসহ ভাইস চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান রিপন, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, রুমিন ফারহানা, নাজিমউদ্দিন আলমসহ অনেকে প্রাথমিক তালিকায় নেই।
বিএনপির অবস্থান
গুলশান কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানান, ২৩৭ আসনের বাইরে বাকি ৬৩ আসনে শরিকদের জন্য জায়গা রাখা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, “যারা মনোনয়ন পাননি, তারা হতাশ হবেন না। দলের জন্য তাদের অবদান ও সম্মান অক্ষুণ্ণ থাকবে।”
বিএনপির ত্যাগী দুই নেতা রুহুল কবির রিজভী ও হাবিব উন নবী খান সোহেল—দলীয় সংকটে যাদের সাহস ও নিষ্ঠা সবচেয়ে বেশি আলোচিত—তাদের নাম এবার না থাকলেও অনেকেই আশা করছেন, চূড়ান্ত তালিকায় পরিবর্তন আসতে পারে। ফেসবুক থেকে মাঠ পর্যন্ত বিএনপি অঙ্গনে এখন একটাই আলোচনার বিষয়: “দলের দুর্দিনের কান্ডারিরা কি আবার ধানের শীষ ফিরে পাবেন?”
