চাটগাঁর সংবাদ ডেস্ক: বন্দরনগরী চট্টগ্রামের যানজট নিরসনের লক্ষ্যে নির্মিত প্রথম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে প্রত্যাশিত যানবাহন উঠছে না। প্রতিদিন গড়ে ২০ হাজার যানবাহন চলাচলের সম্ভাব্যতা থাকলেও এই উড়ালসড়কে দৈনিক মাত্র সাত থেকে আট হাজার গাড়ি উঠছে। মূলত র্যাম্প বা ওঠা-নামার পথ নির্মাণ কাজ শেষ না হওয়ায় এমন অবস্থা চলছে। র্যাম্পেই আটকে আছে প্রায় চার হাজার ৩০০ কোটি টাকার এই মেগা প্রকল্পের সুফল। চলতি বছরের ৩ জানুয়ারি র্যাম্প ছাড়াই এক্সপ্রেসওয়েটি যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয় আনুষ্ঠানিকভাবে। প্রায় ছয় মাস পার হলেও নতুন কোন র্যাম্প চালু হয়নি।
২০১৭ সালে অনুমোদন হওয়া এই প্রকল্পের কাজ আট বছরেও পুরোপুরি শেষ করতে পারেনি প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ- সিডিএ। এখন পর্যন্ত শুধু এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মূল অংশের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। নগরীর বিভিন্ন এলাকা থেকে ওঠা-নামার জন্য ১৫টি র্যাম্প নির্মাণ করার কথা। তবে সরকার পরিবর্তনের পর ছয়টি র্যাম্প বাদ দেওয়া হয়েছে। বাকি নয়টির মধ্যে একটির কাজ শেষ হয়েছে, অন্য আটটির কাজ চলমান রয়েছে। এরফলে এই উড়াল সড়কটিতে কাঙ্খিত সংখ্যক যানবাহন চলাচল করতে পারছে না। এতে নগরীর প্রধান সড়কের যানজট আগের মতোই রয়ে গেছে। তবে সিডিএর কর্মকর্তারা বলছেন, চলতি বছরের শেষ নাগাদ কমপক্ষে আটটি র্যাম্প পুরোদমে চালু করা যাবে। আর তখন প্রকল্পের পুরো সুফল পাওয়া যাবে।
জুলাই বিপ্লবে চট্টগ্রামের প্রথম শহীদ ওয়াসিম আকরামের নামে এই এক্সপ্রেসওয়ের নামকরণ করে সেটি আনুষ্ঠানিকভাবে চালু করা হয়। নির্মাণ শেষ হওয়ার আগেই আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তড়িঘড়ি করে প্রকল্পটি উদ্বোধন করা হয় বিগত ২০২৩ সালের নভেম্বরে। প্রায় এক বছর পরীক্ষামূলক চললেও গত ৩ জানুয়ারি থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে টোল আদায় শুরু হয় এই উড়ালসড়কে।
সিডিএ জানায়, উড়ালসড়কে প্রতিদিন গড়ে ২০ হাজার যানবাহন চলার সম্ভাব্যতা থাকলেও গড়ে প্রতিদিন সাড়ে সাত থেকে আট হাজার গাড়ি চলাচল করছে। প্রতিদিন গড়ে ছয় লাখ টাকা টোল আদায় হচ্ছে। র্যাম্প চালু না হওয়ায় অনেকে এই উড়াল সড়কটি ব্যবহার করতে পারছেন না। বিমানবন্দরে যেতে চাইলে নগরীর এক প্রান্তের মুরাদপুর অথবা ষোলশহর গিয়েই উড়ালসড়কে উঠতে হয়। লালখান বাজারে একটি র্যাম্প থাকলেও সেটি প্রায়ই বন্ধ থাকে। মাঝামাঝি স্থানে ওঠার মতো কোনো র্যাম্প এখনো নির্মাণ করা হয়নি। তাই উড়ালসড়কটি ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছে না নগরবাসী। এতে রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।
দেখা গেছে নগরীর বন্দর নিমতলা বিশ্বরোড এলাকায় র্যাম্পটির একাংশ চালু হয়েছে। ওই র্যাম্প ধরে উল্টোপথে উঠে যানবাহন আগ্রাবাদ হয়ে লালখান বাজার অংশে যেতে পারছে। কিন্তু নিমতলা থেকে পতেঙ্গা অংশে যাওয়ার র্যাম্পটির এখন কাজ শেষ হয়নি।
জিইসি মোড়ের র্যাম্পটির কাজও চলছে ধীরগতিতে। এছাড়া চট্টগ্রাম বন্দরের ৩নং জেটি গেইট লাগোয়া ফকিটর হাট, চট্টগ্রাম ইপিজেড ও ব্যারিস্টার কলেজ এলাকার র্যাম্প নির্মাণ কাজও চলছে কচ্চপ গতিতে। একই চিত্র কর্ণফুলী ইপিজেড এলাকার র্যাম্পটিতেও। বন্দর নগরীর প্রধান সড়কটির বন্দর ইপিজেড এলাকায় যানবাহন চাপ খুব বেশি। মূলত বন্দরকেন্দ্রিক ভারী যানবাহনের চাপে বেসামাল অবস্থা ওই সড়কে। এক্সপ্রেসওয়ে চালু হলে ওই সড়কে যানবাহনে চাপ কমবে এমন প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু ওই এলাকার র্যাম্প নির্মাণ কাজ এখনও শেষ হয়নি। ফলে চট্টগ্রাম বন্দর ও ইপিজেড এলাকায় যানজটেরও অবসান হয়নি।
আগ্রাবাদ ডেবার পার এলাকায় একটি র্যাম্প নির্মাণের পরিকল্পনা থাকলেও সেটির কাজ এখনও শুরু করা যায়নি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নিমতলা বিশ^রোড, ইপিজেড এবং আগ্রাবাদ এলাকার র্যাম্প চালু না হওয়া পর্যন্ত এই প্রকল্পের সুফল পাওয়া যাবে না। প্রকল্প পরিচালক সিডিএর প্রকৌশলী মাফুজুর রহমান বলেন, নিমতলার র্যাম্পের একাংশ চালু হয়েছে। সে পথে যানবাহন চলাচলও করছে। বাকি অংশের কাজ দ্রুত শেষ করা হবে। আগামী এক মাসের মধ্যে ফকিরহাট অংশের র্যাম্পটি চালু হবে। এছাড়া চট্টগ্রাম ইপিজেড ও কর্ণফুলী ইপিজেড এলাকার র্যাম্প নির্মাণ কাজও এগিয়ে যাচ্ছে।
ফকিহাটের অংশে পুলিশের একটি জমি এবং কর্ণফুলী ইপিজেড এলাকায় কিছু ব্যক্তিমালিকানার জমি অধিগ্রহণ করতে হচ্ছে। এই কারণে সেখানে কাজে কিছুটা ধীরগতি চলছে। আগ্রাবাদ ডেবার পাড়ের রেলওয়ের জমি নিয়েও কিছুটা জটিলতা আছে। তবে তিনি আশাবাদি চলতি বছরের শেষ নাগাদ বেশ কয়েকটি র্যাম্প চালু করা যাবে। বর্তমানে এক্সপ্রেসওয়েতে যানবাহন চলাচল আগের তুলনায় বাড়ছে জানিয়ে তিনি বলেন, কয়েকটি র্যাম্প চালু হলে দিনে দশ হাজারের বেশি যানবাহন চলাচল করবে আর তখন গড়ে প্রতিদিন ১০ লাখ টাকা টোল আদায় করা যাবে।
এদিকে সিডিএর নবগঠিত বোর্ডের প্রথম সভায় যানজট বৃদ্ধির অজুহাত এবং ব্যয় সংকোচনের কথা বলে ছয়টি র্যাম্প নির্মাণ স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত হয়। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সমীক্ষা ছাড়া পর্যাপ্ত র্যাম্প নির্মাণ বাদ দিলে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে যানবাহনের সংখ্যা কমবে। ফলে এই উড়ালসড়কের সুফল থেকে নগরবাসী বঞ্চিত হবে। তবে প্রকল্প পরিচালক ও সিডিএর নির্বাহী প্রকৌশলী মাহফুজুর রহমান বলেন, সিডিএ চেয়ারম্যান ও বোর্ড সদস্যরা যাচাই-বাছাই শেষে ছয়টি র্যাম্প নির্মাণ স্থগিতের সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। ভবিষ্যতে চাইলে নির্মাণ করা যাবে। র্যাম্পগুলো চালু হলে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ২০ হাজার গাড়ি চলবে।
বিগত ২০১৮ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে কাজ শুরু হলেও ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি নির্মাণ কাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। তার আগে ২০১৭ সালে একনেকে অনুমোদন হওয়ার সময় তিন হাজার ২৫০ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রকল্পটি তিন বছরের মধ্যে শেষ করার সময় ঠিক করা হয়েছিল। পরে ২০২২ সালে নকশা ‘সংশোধন’ করে আরও এক হাজার ৪৮ কোটি টাকা (আগের ব্যয়ের চেয়ে ৩২ শতাংশ) ব্যয় বাড়িয়ে মেয়াদ ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়। তবে এখনও কাজ শেষ হয়নি।
‘চট্টগ্রাম শহরের লালখান বাজার থেকে শাহ আমানত বিমানবন্দর পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ’ নামে প্রকল্পের কাজ শুরুর পর চট্টগ্রাম বন্দরের আপত্তি, জমি অধিগ্রহণের জন্য অপেক্ষা, ট্রাফিক বিভাগের অনুমতি না পাওয়া, লালখান বাজার অংশের নকশা নিয়ে আপত্তি, কোভিডের সময় কাজে ধীরগতি, বিকল্প সড়ক চালু করতে দেরি এবং সবশেষ বন্দর সংলগ্ন এলাকায় নকশা পরিবর্তনসহ নানা কারণে প্রকল্প কাজে বিলম্ব হয়। কাজের ধীরগতির জন্য নগরীর বিশাল অংশের বাসিন্দাদের সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হয়।
নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নানা জটিলতা আর অনেক দুর্ভোগের পর এক্সপ্রেসওয়েটি চালু হওয়ার কিছুটা হলেও সুফল মিলছে। কম সময়ে বিমানবন্দর এবং পতেঙ্গা এলাকা থেকে মূল শহরে আসা-যাওয়া করা যাচ্ছে। তবে র্যাম্প চালু হলে এর পুরো সুফল পাবে নগরবাসী।
Leave a Reply