আজ ১৩ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৬শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

“আমাদের নার্স আমাদের ভবিষ্যৎ”


আজ ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল’র জন্মদিন, আন্তর্জাতিক নার্সেস দিবস

 

আজ ১২ মে নার্সিং পেশার পথিকৃৎ ও স্মরণীয় মনিষী ইতালিয়ান বংশোদ্ভূত ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল’র জন্মদিন। এ দিনকে ঘিরে সারা বিশ্বে পালিত হবে আন্তর্জাতিক নার্সেস দিবস। এবারের (২০২৩ সালের) প্রতিপাদ্য হচ্ছে “আমাদের নার্স; আমাদের ভবিষ্যৎ” Our Nurses. Our Future)। ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল অব নার্সেস (আইসিএন) আন্তর্জাতিক নার্স দিবস ২০২৩’র এ প্রতিপাদ্য ঘোষণা করে। আজকের ইন্টারন্যাশনার নার্সেস ডে উপলক্ষ্যে সরকারি ও বেসরকারিভাবে বিভিন্ন কর্মসুচি পালিত হবে। প্রত্যেকটি জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ (সিএস দপ্তর), মেডিকেল কলেজ, নার্সিং কলেজ, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ইত্যাদিতে দিবসটি উপলক্ষ্যে রয়েছে নানা কর্মসূচি। এ দিবসের কর্মসূচি মহান নার্সিং পেশাকে আরো দায়িত্বশীল ও শ্রদ্ধাশীল হতে প্রেরণা যোগাবে।


বহু শ্রেণি-পেশার লোক বাস করেন আমাদের সমাজে। ভিন্ন ভিন্ন পেশার লোকজনের ভিন্ন ভিন্ন কাজ ও বৈশিষ্ট্য। এদের একটি হচ্ছে ‘নার্স’/ ‘নার্সেস’। নার্সদের অধিকাংশ নারী হলেও একটি অংশ রয়েছে পুরুষ। নার্সের বাংলায় সেবিকা বলা হয়। সাধারণত তাঁদের সিস্টার/ ব্রাদার বলা হয়। সিস্টার/ ব্রাদার খ্রিস্ট্রধর্মীয় পদ হলেও সিস্টার/ ব্রাদার শব্দের বাংলা অর্থ বোন/ ভাই। একজন গুণধর বোন যেমন ভাই-বোনসহ মাতা-পিতা ও পরিবারের অন্যান্যদের আন্তরিকতা দিয়ে সেবা করেন, সুখ-শান্তি ও প্রগতি কামনা করেন। নার্সেস পেশার লোকদের পেশাগত ইউনিফরম বা ড্রেস সাদা বর্ণের। তাদের পোশাক যেমন সাদা, তেমনি মনও যেন সাদা। যদিও ইদানীং নার্সের ইউনিফর্মে ভিন্ন বর্ণ যোগ হচ্ছে। নার্সরা দিন রাত সারাক্ষণ মানবসেবায় ব্যস্ত থাকেন। অফিসিয়াল ডিউটি ৮ ঘন্টা হলেও তাঁরা সবসময় গণমানুষের কল্যাণ কামনা করেন। মানব দেহের সুস্থতা ও সুখ কামনা করেন। আন্তরিক সেবা শুশ্রুষা দিয়ে রোগীদের সুস্থ করে তোলেন, মানসিক প্রশান্তি বিলিয়ে দেন।

নার্সদেরই এক কিংবদন্তী চরিত্র হলো “ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল”। তিনি আধুনিক নার্সিং এর অগ্রদূত, পরিসংখ্যানবিদ ও লেখক। “ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল” কেবল নাম নয়, যেন বিশ্ব ইতিহাস। পৃথিবীর ইতিহাসে যত মহীয়সী নারী রয়েছে তাদের মধ্যে ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল অন্যতম। ১২ মে ১৮২০ সালে ইটালীর ফ্লোরেন্স শহরে ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল এর জন্ম হয়।

১৯১০ সালের ১৩ আগস্ট ৯০ বছর বয়সে এই মহীয়সী নারী চলে যান পৃথিবী ছেড়ে মৃত্যু বরণ করেন। শহরের নামের সঙ্গে মিল রেখে ফ্লোরেন্স নাইটিংগেলের নাম রাখেন তাঁর পিতা। তিনি তার জীবনের সবটুকু সময় ব্যয় করেছেন মানুষের সেবায়। ক্রিমিয়ার যুদ্ধে আহত সৈন্যদের পরিচর্যার মাধ্যমে নার্সিং শিল্পের অগ্রদূত হিসেবে তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। দীর্ঘকাল ধরে ইউরোপের আধিপত্য নিয়ে দ্বন্দ্ব-যুদ্ধ চলছিলো ফ্রান্স, ব্রিটেন ও কিংডম অব সার্ডিনিয়ার সাথে রাশিয়ার। ১৮৫৩ সালে সেই দ্বন্দ্বই যুদ্ধে রূপ নেয় যা ইতিহাসে ক্রিমিয়ার যুদ্ধ নামে পরিচিত। তিন বছরের সেই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে জাতি, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানবতার সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল। ক্রিমিয়ার যুদ্ধে বহু সেনা টাইফয়েড ও কলেরায় আক্রান্ত হয়েছিল। নাইটিঙ্গেল সেই সেনাদের পরম যত্নে সেবা দিয়ে তাদের অনেককে সারিয়ে তুলেছিলেন।

১৮৫৪ সালে তুরস্কের বিরুদ্ধে রাশিয়া যুদ্ধ ঘোষনা করলো। আত্মীয়-স্বজন পরিজনের সব বাঁধা উপেক্ষা করে ফ্লোরেন্স তুরস্কের হাসপাতালে সুপারিনটেন্ডেন্ট পদে যোগ দেন। ফ্লোরেন্স ছিলেন এই হাসপাতালের এক সেবার প্রতিমূর্তি। দিনরাত অকাতরে তিনি সেবা করে যেতেন। রোগীরা তার নাম দিয়েছিলো দীপ হাতে রমণী। তিনি নারীমুক্তির জন্যও পূর্ণমাত্রায় সোচ্চার ছিলেন। ফ্লেরেন্স তাঁর জীবদ্দশায ১৮৫৩ সাল থেকে ১৮৫৪ সাল পর্যন্ত লন্ডনের ‘কেযার অব সিক জেন্টলওমেন ইনিস্টিটিউটের’ তত্ত্বাবধায়ক হিসাবে কাজ করে গেছেন। যুদ্ধের পর তিনি বহু দাতব্য প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন।

ফ্লোরেন্স নাইটিংগেলের জন্ম ইটালির ফ্লোরেন্সে হলেও ছোটবেলার শৈশব কেটেছে ইংল্যান্ডের ডার্বিশায়। পিতা ধনাঢ্য ব্যবসায়ী হওয়ায় উচ্চ শিক্ষার সুযোগ লাভ করে ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল। পিতার ইচ্ছা ছিল ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে পৃথিবীর বিখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু না, সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্ম নেয়া ফ্লোরেন্স নাইটিংগেলের জীবন কাটিয়েছেন কঠিন দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত অসহায় মানুষের সেবা-পরিচর্চার মধ্যদিয়ে। ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল ছিল অত্যন্ত মেধাবী। অল্প সময়ের মধ্যে ল্যাটিন, গ্রিক, ইটালিয়ান, ফরাসি, জার্মানসহ ইত্যাদির ভাষা অল্প সময়ে আয়ত্ত করে ফেলেন।

১৮৪৯ সালে যখন ফ্লোরেন্স নাইটিংগেলের বয়স ২৯ তখন প্যারিসে সেন্ট ভিনসেন্ট সোসাইটির দু’জন সন্ন্যাসিনীর সঙ্গে পরিচয় হয়। আলেকজান্দ্রিয়ায় এই সোসাইটির একটি হাসপাতাল ছিল সেখানেই ফ্লোরেন্স নাইটিংগেলের সেবিকা হওয়ার ইচ্ছা জাগে। মানব কল্যাণে ফ্লোরেন্স নাইটিংগেলের জাগ্রত ইচ্ছার প্রতি পিতা-মাতার সম্মতিতে লন্ডনের হার্লে স্ট্রিটে মহিলা হাসপাতালের সুপারিনটেনডেন্ট পদে নাইটিংগেল যোগদান করেন। সে থেকে শুরু মানব কল্যাণে মহান পেশায় জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত অবিচল ছিল।

জানা যায়, ১৯৫৪ সালে তুরস্কের বিরুদ্ধে রাশিয়ার যুদ্ধ শুরু হলে বিপন্ন তুরস্ককে সাহায্যে এগিয়ে আসে ইংল্যান্ডের সেনাবাহিনী। তুমুল যুদ্ধে বিপর্যস্ত পরিবেশে যখন প্রতিদিন মানুষ মারা যাচ্ছিল তখন ঐ সময়ের প্রতিরক্ষার দফতরের সেক্রেটারি ফ্লোরেন্স নাইটিংগেলকে আর্তমানবতার সেবায় এগিয়ে আসার আহবান জানান। সে আহবানে আত্মীয়-স্বজনদের বাধা উপেক্ষা করে মানব কল্যাণে ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল পাশে এসে দাঁড়ান। তখন ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল ৩৮ জন মহিলাকে একটি দল তৈরি করেন। দীর্ঘ দুই বছর ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল যুদ্ধাহত মানুষের চিকিৎসা সেবায় অসামান্য অবদান রাখেন। ১৮৫৬ সালে যুদ্ধ শেষে ফিরে আসেন স্বদেশ ভূমিতে। ১৮৫৯ সালে সেন্ট টমাস হাসপাতালে ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল হোম নামে আধুনিক নার্সিং শিক্ষার প্রথম নার্সিং স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন।

এছাড়া ১৮৫৮ সালে তিনি আটশো পৃষ্ঠার ôvi “Note on matters affecting the health, and Hospital Administration of the British Army” নামক একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেন। এছাড়া তিনি নার্সিং- এর উপর অনেক বই পুস্তক লিখেছেন। ইংল্যান্ডের মানুষ তাকে সম্মান জানাতে তৎকালীন সময়ে ৫০ হাজার পাউন্ড অর্থ উপর দেন। যা তিনি নার্সিং শিক্ষা বিকাশে ব্যয় করেন। তার কল্যাণে আজ সারাবিশ্বে নার্সিং শিক্ষার বিপ্লব ঘটেছে। এই পেশাকে এখনও যারা ছোট মনে করে তারা যেন গুহায় বাস করে। এই মহান পেশা যে কত পরম সম্মানের সেটা অনুধাবন করতে হবে।
এটা সত্য যে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠা ব্যক্তি মালিকানাধীন হাসপাতাল- ক্লিনিকে তথাকথিক নার্সিং শিক্ষাহীন এইডনার্সরা নার্সিং পেশার মর্যাদা ক্ষুণ্ন করছে।

তাই ফ্লোরেন্স নাইটিংগেলের জীবন ও কর্ম তথা পেশার মর্যাদা রক্ষায় নার্সিং শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও নার্সদের এগিয়ে আসতে হবে। ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল বিশ্বাস করতেন রোগ নিরাময়ে ওষুধের পাশাপাশি প্রয়োজন পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পরিবেশ। তাই ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল যখন যেখানে সেবার দরজা খুলেছে সেখানে সুন্দর পরিবেশ সবার আগে নিশ্চিত করেছে। মানুষের দুঃখ কষ্টে শরীক হওয়ার পাশাপাশি জানার আকাঙ্খা ছিল ফ্লোরেন্স নাইটিংগেলের সবচেয়ে বেশি। তাই ফ্লোরেন্স নাইটিংগেলের অগাধ সাহস, প্রখর চিন্তাচেতনা ও অসাধারণ কর্মপ্রচেষ্টার কারণে পৃথিবীর ইতিহাসে বিশ্বের সেরা ১০০ ব্যক্তিত্বের আসনে আসীন হতে পেরেছেন। ক্ষণজন্মা এই মহীয়সী নারীর কল্যাণে আন্তর্জাতিক নার্স দিবস এ নার্সিং পেশার মর্যাদাকে অনেক গুণ বাড়িয়ে দিল। জীবন সংগ্রামে যারা পেশাগত জীবনে নীতি ও আদর্শের প্রতি অবিচল থাকেন তাদের মধ্যে নার্সিং পেশা অন্যতম।

ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল ও নার্সদের প্রতি মানুষের মমত্ববোধ ও সম্মান বৃদ্ধি পেতে প্রেরণা যোগাবে। এ পেশার লোকদের সম্মান ও জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে বিশ্ব ও রাষ্ট্র আরো আন্তরিক হবে- এটা তাঁদের প্রত্যাশা। ১২ মে আন্তর্জাতিক নার্সেস (ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল) দিবস ও কর্মসূচি মহান নার্সিং পেশাকে আরো দায়িত্বশীল ও শ্রদ্ধাশীল করতে সচেতনতা সৃষ্টি করবে এবং নারর্সদের প্রতি গণমানুষের শ্রদ্ধাবোধ বাড়াবে।

লেখক: সৈয়দ শিবলী ছাদেক কফিল, সাংবাদিক ও ছড়াকার।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     এই বিভাগের আরও খবর