আজ ৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৯শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

এলপিজিতেও জিম্মি সাধারণ মানুষ


চাটগাঁর সংবাদ ডেস্ক: খুচরা পর্যায়ে বর্তমানে বেসরকারি খাতের ১২ কেজি ওজনের তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) সরকার নির্ধারিত দাম ১৪৯৮ টাকা, যা গত মাসে ছিল ১২৩২ টাকা। কিন্তু বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১৭০০ থেকে ১৮৫০ টাকা দরে। চলতি মাসে এলপিজির দাম সমন্বয় করেছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। তাতে আগের মাসের চেয়ে ১২ কেজির সিলিন্ডারে দাম বেড়েছে ২৬৬ টাকা। এর সঙ্গে ব্যবসায়ীরা বাড়িয়েছেন আরও ২০০—৩৫০ টাকা। সব মিলে গত মাসের তুলনায় এ মাসে ১২ কেজি এলপিজির জন্য প্রায় ৬০০ টাকা অতিরিক্ত ব্যয় হচ্ছে ভোক্তার। খুচরা এলপি গ্যাস বিক্রিতারা সব খরচ বাদ দিয়েই ১২ কেজির সিলিন্ডারপ্রতি ৩৮ টাকা মুনাফা পায়। অন্যদিকে সরকারি প্রতিষ্ঠানের সাড়ে ১২ কেজির এলপিজি সিলিন্ডারের দাম ৫৯১ টাকা হলেও এর সরবরাহের পরিমাণ এতই কম যে, সাধারণ মানুষের কাছে তা পৌঁছায় না।

এদিকে ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে এলপি গ্যাসের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য (এমআরপি) নির্ধারণ করে ওই বছরের ১ মার্চের মধ্যে সিলিন্ডারের গায়ে লিখে দেওয়ার নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট। কিন্তু সেই নির্দেশনাও বাস্তবায়ন নেই। জ¦ালানি বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আবাসিকে পাইপলাইনে সরবরাহকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস সংযোগ বন্ধ রাখা এবং একমাত্র রাষ্ট্রীয় এলপিজি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সরবরাহ ক্ষমতা দীর্ঘদিন ধরে ১.৫ শতাংশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখার কারণে এই নৈরাজ্য বন্ধ হচ্ছে না। এলপিজি খাতের ব্যবসায়ীদের সুবিধা দিতেই এটা করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেছেন অনেকে।

ভোক্তা অধিকার নিশ্চিত করতে উচ্চ আদালতের নির্দেশে ২০২১ সালের এপ্রিলে দেশে প্রথমবারের মতো এলপিজির দাম নির্ধারণ করে বিইআরসি। এরপর থেকে প্রতি মাসে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে একবার দাম সমন্বয় করা হলেও কখনোই এ দামে এলপিজি পান না ভোক্তারা। দাম নির্ধারণের পর তা বাস্তবায়ন হচ্ছে কি না সে ব্যাপারে কমিশনের তেমন কোনো পদক্ষেপ চোখে পড়ে না। ফলে এলপিজির বাজারে দাম নিয়ে বছরের পর বছর ধরে চলছে চরম নৈরাজ্য। যার শিকার ভোক্তারা।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান বলেন, বাজার যাচাই করে দেখা গেছে বর্তমানে কমিশন নির্ধারিত দামের চেয়ে ৩০০ টাকা পর্যন্ত বেশি দামে এলপিজি বিক্রি হচ্ছে। এটা বড় ধরনের অপরাধ। তিনি বলেন, ‘আমরা লাইসেন্সি প্রতিষ্ঠানও না আবার এলপিজির দামও নির্ধারণ করি না। তারপরও ভোক্তাদের স্বার্থরক্ষায় বিভিন্ন সময় বাজার মনিটরিং করছি। ভোক্তা ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করছি। অভিযোগ প্রমাণিত হলে জরিমানা করছি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে যে দপ্তরের এ কাজ করার দায়িত্ব তাদের আরও সক্রিয় হতে হবে। না হলে শুধু ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পক্ষে একা এ নৈরাজ্য বন্ধ করা সম্ভব হবে না।’
২০১০ সালে সরকার আবাসিক খাতে নতুন গ্যাস সংযোগ বন্ধ করে দেওয়ার পর দেশে এলপি গ্যাসের ব্যবহার বাড়তে থাকে। ২০০৮ সালে দেশে এলপি গ্যাসের মোট ব্যবহার ছিল যেখানে ৫০ হাজার টন, সেখানে বর্তমানে চাহিদা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩ থেকে ১৪ লাখ টন।
রাষ্ট্রায়ত্ত এলপি গ্যাস লিমিটেডের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত এক দশকে দেশে প্রতি বছর এলপিজির ব্যবহার বেড়েছে গড়ে ৩৫ শতাংশ করে। প্রবৃদ্ধির এ ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৪১ সালে এলপিজির চাহিদা হবে প্রায় ৭৮ লাখ টন। বর্তমানে ১৩ শতাংশ রান্নায় পাইপলাইনের প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহারকারী। তবে অনেক সময় চাপ কম থাকায় চুলা না জ¦লায় তাদের একটা অংশ এলপিজি ব্যবহার করছেন বাধ্য হয়ে।

বাজারে সরকার নির্ধারিত দামে এলপি গ্যাস না পাওয়া, মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডার ব্যবহার এবং অবৈধভাবে বড় থেকে ছোট সিলিন্ডারে গ্যাস ভরে বিক্রিসহ নানা অভিযোগ ভূরি ভূরি। এ সংক্রান্ত অভিযোগের প্রমাণও পেয়েছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর এবং বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন। এলপি গ্যাস উৎপাদনকারী, বাজারজাতকারী এবং ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের সঙ্গে একাধিবার মতবিনিময় সভায় এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান। বিষয়টি নিয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে তারা চিঠিও দিয়েছেন।

সর্বশেষ গত ৮ ফেব্রুয়ারি সংস্থাটির প্রধান কার্যালয়ে এলপিজি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় মহাপরিচালক বলেন, এলপিজির দাম সরকার যেটুকু বাড়ায়, খুচরা বাজারে দাম বাড়ানো হয় তার চেয়ে বেশি। এমনটা হলে সরকারিভাবে বেঁধে দেওয়া দামের কোনো কার্যকারিতা থাকে না। সভায় খুচরা ব্যবসায়ীরা বলেন, ভোক্তা পর্যায়ে দাম বেঁধে দেওয়ার সময় এলপিজি বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ডিলারদের থেকে কত টাকা রাখবে অর্থাৎ তাদের কমিশন কত হবে, তাও নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। ডিলাররা খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বেশি দাম রাখছেন। তখন নিরুপায় হয়ে তাদেরও বাড়তি দামে সিলিন্ডার বিক্রি করতে হয়। এ সমস্যার সমাধান হলে ভালোভাবে ব্যবসা করা যাবে বলে মনে করেন এসব ব্যবসায়ী।

ওই সভায় বিইআরসি সচিব মো. খলিলুর রহমান বলেন, বিশ্ববাজারে এলপিজির দাম বাড়লেই ওই পণ্য দেশে প্রবেশ করার আগেই দেশের বাজারে দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়। আইন অনুযায়ী নির্ধারিত দামের বেশি রাখলে সেটা অপরাধ, কারণ উৎপাদকের মূল্য ও খুচরা মূল্য বিবেচনায় এনে এলপিজির দাম বেঁধে দেওয়া হয়। এরপরও বাড়তি দাম নেওয়ার বিষয়টি দুঃখজনক। বাড়তি দাম দেওয়ার পরও কেন ভোক্তারা অভিযোগ করেন না তা জানতে বেশ কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ হয়, যাদের প্রায় সবাই একই অভিমত ব্যক্ত করেছেন। এদেরই একজন মিরপুরের বাসিন্দা আবদুর রশিদ বলছিলেন, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর কিংবা কমিশনে অভিযোগ করা কিছুটা ঝক্কি—ঝামেলার ব্যাপার। এরপরও অভিযোগ জানালে হয়তো সাময়িক প্রতিকার পাওয়া যাবে। কিন্তু স্থানীয় ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করে পরে অন্য ঝামেলার সৃষ্টি হতে পারে। তাছাড়া দীর্ঘ মেয়াদে তো তাদের কাছ থেকেই গ্যাস নিতে হবে।ভোক্তাদের কেউ কেউ আবার জানেন না কোথায় কীভাবে এর প্রতিকার পাবেন। ফলে মুখ বুঁজে ব্যবসায়ীদের সব নৈরাজ্য সহ্য করেন মাসের পর মাস।

এদিকে রাষ্ট্রায়ত্ত এলপি গ্যাস লিমিটেডের সাড়ে ১২ কেজি ওজনের সিলিন্ডারের বাজারমূল্য ৫৯১ টাকা। বেসরকারি এলপিজির দাম প্রতি মাসে বাড়লেও দেশে উৎপাদন হওয়ায় এর দাম একই থাকে। ওজনে বেশি, দামে সাশ্রয়ী সরকারি এলপিজির মার্কেট শেয়ার মাত্র ১.৫ শতাংশ হওয়ায় এ গ্যাস সাধারণ ভোক্তা পর্যন্ত খুব একটা পৌঁছায় না। ফলে বেসরকারি এলপিজি ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্যে সাধারণ মানুষ হয়রানির শিকার হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘদিন ধরে সরকারি এলপিজির সক্ষমতা বাড়ানোর পরামর্শ দিলেও তা আমলে নেওয়া হচ্ছে না।

১৯৭৭—৭৮ সালে চট্টগ্রামের উত্তর পতেঙ্গায় একটি প্রকল্পের আওতায় এলপিজি স্টোরেজ ও বটলিং প্ল্যান্ট নির্মাণ করে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান যমুনা অয়েল কোম্পানি লিমিটেড। ১৯৮৩ সালে এ প্রকল্পটি ‘এলপি গ্যাস লিমিটেড’ নামে বিপিসির একটি সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে যাত্রা শুরু করে। পরে এলপিজি বোতলজাত ও বাজারজাত করার লক্ষ্যে ১৯৯৫ সালে বিপিসি সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার কৈলাশটিলায় আরও একটি এলপিজি স্টোরেজ, বটলিং ও ডিস্ট্রিবিউশন প্ল্যান্ট তৈরি হয় যা ১৯৯৮ সালে উৎপাদনে যায়। এ দুটি প্ল্যান্ট এলপি গ্যাস লিমিটেডের অধীনে।

বর্তমানে রাষ্ট্রায়ত্ত এলপি গ্যাস লিমিটেডের চট্টগ্রামে সাড়ে ১৪ হাজার টন এবং সিলেটের কৈলাশটিলায় সাড়ে ৯ হাজার টন ক্ষমতাসম্পন্ন দুটি এলপিজি প্ল্যান্ট রয়েছে। এর মধ্যে কাঁচামালের অভাবে বেশ কয়েক মাস ধরে বন্ধ রয়েছে কৈলাশটিলা প্ল্যান্ট। ভোক্তাদের সাশ্রয়ী দামে এলপিজি সরবরাহের জন্য কয়েক বছর ধরে এলপিজি আমদানির পরিকল্পনা করছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। পরিকল্পনা অনুযায়ী, বছরে ১০ থেকে ১২ লাখ টন এলপিজি সরবরাহের সক্ষমতা সম্পন্ন টার্মিনাল নির্মাণ করা হবে কক্সবাজারে। এতে ১২ কেজির এলপিজি সিলিন্ডারের দাম প্রায় ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা কমতে পারে। কিন্তু এ উদ্যোগ এখনো পরিকল্পনাতেই ঘুরপাক খাচ্ছে।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সিনিয়র সহসভাপতি ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, ‘কমিশন নির্ধারিত দামের অতিরিক্ত দাম আদায় করা গর্হিত অপরাধ। যারা এসব অপরাধের সঙ্গে জড়িত তাদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে।’ তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য সরকারি প্রতিষ্ঠান বড় ভূমিকা রাখে। কিন্তু আমাদের দেশে রাষ্ট্রায়ত্ত এলপি গ্যাস লিমিটেডের যে সক্ষমতা তা দিয়ে ভোক্তার স্বার্থরক্ষা করা যাবে না। সরকারি প্রতিষ্ঠানের মার্কেট শেয়ার বাড়লে এ নৈরাজ্য কমবে। পাশাপাশি নিয়ন্ত্রক সংস্থা এবং সংশ্লিষ্টদের নিয়মিত বাজার মনিটরিং করতে হবে। পাশাপাশি ভোক্তাদেরও সোচ্চার হতে হবে। নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দাম দিয়ে এলপিজি কিনলে বিইআরসি এবং জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে অভিযোগ জানাতে পারেন। এ ছাড়া ক্যাবের কাছে অভিযোগ করলেও আমরা সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ভোক্তার স্বার্থরক্ষায় আইনি ব্যবস্থার বিষয়ে সহায়তা করব।’

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে কর্মকর্তারা বলছেন, অতিরিক্ত দাম আদায়ের বিষয়ে কেউ অভিযোগ করতে চাইলে এলপিজি কেনার রসিদসহ তাদের কাছে আবেদন করতে হবে। অতিরিক্ত মূল্য আদায়ের অভিযোগ প্রমাণিত হলে মোট জরিমানার ২৫ শতাংশ পাবেন ওই অভিযোগকারী। অধিদপ্তরের িিি. ফহপৎঢ়.পড়স এ ওয়েবসাইটে গিয়ে বিস্তারিত জানা যাবে।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     এই বিভাগের আরও খবর