আজ ১২ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৫শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক এখন মরণফাঁদ


  • মোঃ জাহেদুল ইসলাম

ইটভাটায় নিয়ে যাওয়ার সময় ট্রাক থেকে পড়া মাটি বৃষ্টিতে কাদায় পরিণত হয়ে ভয়ংকর মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক। এতে দুর্ঘটনার শিকার বিভিন্ন যানবাহন। গত ১৯ মার্চ (রবিবার) সকালে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হলে মহাসড়ক কাঁদা পানিতে একাকার হয়ে যায়। তাছাড়া কাঁদা মাটির সাথে রয়েছে লবণবাহী গাড়ি থেকে নিসৃত লবণ পানি। ফলে সকালে প্রায় কয়েক ঘণ্টা মহাসড়ক পিচ্ছিল হয়ে যানচলাচল বন্ধ হয়ে যায়। মুহূর্তের মধ্যে মহাসড়ক পরিণত হয় মরণফাঁদে। যার কারণে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে সড়কের দু’পাশে কয়েক কিলোমিটার দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। এতে দেশি-বিদেশি পর্যটকসহ যাত্রী ও পথচারীরা সীমাহীন দুর্ভোগে পড়েন। দুপুরে বৃষ্টির ফোঁটা কমলে সড়ক কিছুটা শুকিয়ে যাওয়ার পরে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়।

সংশ্লিষ্টরা জানান, শুকনো মৌসুমে পাকা সড়কের ওপর থাকা এই মাটি তেমন বিপদজনক না হলেও বৃষ্টির পানিতে পাকা সড়কের ওপর পড়ে থাকা ওই মাটিগুলো কাঁদা হয়ে মরণফাঁদে পরিণত হয়। এতে করে এই সব সড়কের চলাচল করা মোটরসাইকেল, বাস-ট্রাকসহ ছোটবড় সকল প্রকারের যানবাহনের চাকা পিছলে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনা ঘটে।

চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের সাতকানিয়া অংশের কয়েক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে মাটির প্রলেপ জমেছে। গত কয়েক মাস ধরে ইটভাটার জন্য ডাম্প ট্রাকে পরিবহনের সময় সড়কে এঁটেল কাদামাটি পড়ে সড়ক এখন কাদা সড়কে পরিণত হয়েছে। পথচারীরা সড়কে চলাচল করতে পারছে না। বিশেষত দুর্ভোগের মুখে পড়েছেন মোটরসাইকেল চালকেরা। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা মোটরসাইকেল চালাচ্ছেন। সড়কের পাশের লোকজন ও ব্যবসায়ীদের পড়তে হয়েছে চরম ভোগান্তিতে। ইটভাটার ট্রাকের ধারণ ক্ষমতার চেয়ে অতিরিক্ত বহন করা মাটি সড়কে পড়ে। বেশ কিছুদিন ধরে ধুলায় টিকে থাকা দায় হয়ে পড়েছিল। এখন বৃষ্টি হওয়াতে পাকা সড়কগুলো কাদাময় হয়ে পড়েছে। চলাচলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজে বেড়েছে দুর্ভোগ।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, মৌলভীর দোকান, নয়াখাল, আন্দার মা’র দরগাহ ও কেরানীহাট গরুর বাজার এলাকায় গাড়ি যানজটে আটকে পড়ায় বিভিন্ন গন্তব্যের যাত্রীরা পায়ে হেঁটেই গন্তব্যে পৌঁছার চেষ্টা চালান। বেশ কয়েকটি যানবাহন পিচ্ছিল মহাসড়কে চালানোর চেষ্টা করলে পিছলে মহাসড়ক থেকে নিচে মাটিতে পড়ে যায়।

সাতকানিয়ার জনার কেঁওচিয়ার বাসিন্দা জহির আহমদ জানান, মাটি ব্যবসায়ীরা দিনে-রাতে মহাসড়কের উপর দিয়ে মাটিভর্তি ট্রাক নিয়েছে। তাদের গাড়ি থেকে ঝরে পড়া মাটির কারণে সড়ক পিচ্ছিল হয়ে যাওয়ার পর কোনো মাটি ব্যবসায়ীকে রাস্তায় দেখা যায়নি। তাদের উচিত ছিল সড়ক থেকে এসব কাদামাটি অপসারণ করা। প্রশাসনের উচিত মাটি ব্যবসায়ীদেরকে দিয়ে সড়ক থেকে এসব কাদামাটি সরানোর ব্যবস্থা করা।

তিনি আরো জানান, এসব মাটি ব্যবসার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গেলে সাধারণ লোকজনকে তারা নানাভাবে নাজেহাল করে। ফলে এখন কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পায় না। প্রশাসনের উচিত আবাদি জমির মাটি কাটা এবং মহাসড়কের উপর দিয়ে নেয়া বন্ধ করা।

সাতকানিয়ার কেরানীহাট এলাকার ড্রাইভার আবদুর রশিদ জানান, বৃষ্টির পর কেরানীহাট থেকে মৌলভীর দোকান পর্যন্ত সড়কটি চাষ দেয়া জমির মতো হয়ে গিয়েছিল। তখন গাড়ি চালানো দূরের কথা, সড়কের উপর দিয়ে পায়ে হাঁটাও মুশকিল হয়ে পড়েছিল। মহাসড়কের উপর দিয়ে মাটি নেয়া বন্ধ করা দরকার। বৃষ্টি সকালে না হয়ে রাতে হলে অনেক যানবাহন দুর্ঘটনায় পতিত হতো। আজও পিচ্ছিল সড়কের উপর দিয়ে চলতে গিয়ে বেশ কিছু গাড়ি সড়ক থেকে ছিটকে পড়েছে। বহু গাড়ি সড়কের উপর ঘুরে গেছে।

সাতকানিয়ার সতি পাড়ার বাসিন্দা মো. আকিব বলেন, সড়কে মাটির প্রলেপ জমছে কয়েক মাস ধরে। সকালে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি হলে মহাসড়ক পিচ্ছিল হয়ে মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠে। যানজটের কারণে সাতকানিয়া থেকে চট্টগ্রাম পৌঁছাতে এক ঘণ্টার পরিবর্তে চার ঘণ্টা সময় লেগেছে।

কালিয়াইশের বাসিন্দা মো, দেলোয়ার হোসেন জানান, কেঁওচিয়া, তেমুহনী ও কালিয়াইশের বিল থেকে মাটি কেটে মহাসড়ক দিয়ে পরিবহন করায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। আমি জরুরি কাজে উপজেলা সদরে যাওয়ার জন্য বের হয়েছি। কাদায় সড়ক পিচ্ছিল হয়ে যান চলাচল বন্ধ থাকায় মৌলভীর দোকান থেকে পায়ে হেঁটে অনেক কষ্টে কেরানীহাট এসেছি।

বাস সুপারবাইজার এনামুল হক বলেন, মাটি পরিবহণের ফলে বৃষ্টিতে সড়ক পিচ্ছিল হয়ে যাওয়ায় ৩ ঘণ্টা ধরে যানজটে আটকা পড়েছি। চালাতে গিয়ে গাড়ি সড়ক থেকে নেমে যাচ্ছে। সড়ক দিয়ে মাটি পরিবহণ বন্ধ করা না হলে বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে।

এদিকে পিচ্ছিল মহাসড়কের পাশে দাঁড়িয়ে যানজটের দৃশ্য তুলে ধরে এক ভিডিও বার্তায় মাটি ব্যবসায়ীদের এক হাত নিলেন বান্দরবান সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী রাফি চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘মাটি ব্যবসা করতেছেন ঠিক আছে। কিন্তু এ রাস্তা কারো বাপের না। রাস্তাটা ধ্বংস করে দিচ্ছেন। কেউ যাচ্ছে চাকরিতে। যারা দৈনিক চাকরি না করলে তারা তাদের পরিবার চালাতে পারবে না। কেউ চিকিৎসার জন্য হাসপতালে যাচ্ছেন। এমন পরিস্থিতিতে বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে দায় কি কেউ নেবে?’ পিচ্ছিল সড়কে গাড়ি চলাচল ব্যাহত হওয়ায় কোচিংয়ের কয়েকটি ক্লাস করতে পারেননি বলে জানান তিনি। তাই এ বিষয়ে দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে জোর দাবি জানিয়েছেন এ শিক্ষার্থী।

সাতকানিয়া ইটভাটা মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. ফরিদুল আলম বলেন, ‘মাটি ব্যবসায়ীরা বিল থেকে মাটি কেটে ট্রাকে করে ইটভাটায় নেয়ার সময় সড়কের উপর ঝরে পড়ার বিষয়টি সত্য। আবার সড়কের আঁধার মার দরগাহ এলাকায় নির্মাণাধীন স্কেলের জন্য মাটি আনার সময়ও সড়কের উপর পড়েছে। তারপরও মাটি ব্যবসায়ী এবং ইটভাটা মালিকরা দায় এড়াতে পারে না। আমি সমিতির সভা ডেকে ইটভাটা মালিক এবং মাটি ব্যবসায়ীদেরকে বারবার বলেছি যাতে করে মাটি আনার পর প্রতিদিন সড়ক ধুয়ে দেয়। এভাবে প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে সড়ক ধুয়ে দিলে এমন পরিস্থিতি তৈরি হতো না।বিষয়টি আমি প্রশাসনের নজরেও দিয়েছিলাম। সড়কে মাটির প্রলেপ দেখে মাটি ব্যবসায়ী ও ইটভাটা মালিকদের বার বার অনুরোধ করেছি কিন্তু বিষয়টি তারা আমলে নেয়নি। মাটির প্রলেপের উপর বৃষ্টি পড়ে সড়ক পিচ্ছিল হওয়ার বিষয়ে আমি খুবই লজ্জিত ও দুঃখিত যদিও আমার কোনো ইটভাটায় মহাসড়কের উপর দিয়ে মাটি আনা হয় না।’

দোহাজারী হাইওয়ে থানার অফিসার ইনচার্জ খান মোহাম্মদ এরফান বলেন, সকালে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হলে মহসড়ক কাঁদায় পিচ্ছিল হয়ে যানবাহনসহ অন্যান্য গাড়ি একটু ধীরগতিতে চলেছে। ফলে কিছুক্ষণ যানজটের সৃষ্টি হয়েছিল।

দোহাজারী সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী সুমন সিংহ জানান, সড়কে মাটির প্রলেপ এবং বৃষ্টির পর পিচ্ছিল হওয়ার বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য হাইওয়ে থানার ওসিকে বলা হয়েছে। এর বাইরে আমাদের আসলে কিছুই করার নাই।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     এই বিভাগের আরও খবর