অনলাইন ডেস্কঃ ’৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি (৮ ফাল্গুন ১৩৫৮ বঙ্গাব্দ) বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ উৎসর্গ করা শহিদদের নিয়ে লেখা প্রথম কবিতা ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ কবিতাটির একটি অংশে কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী লিখেছিলেন, ‘বেঁচে থাকলে যারা হতো পাকিস্তানের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ, যাদের মধ্যে লিংকন, রকফেলার, আরাগঁ, আইনস্টাইন আশ্রয় পেয়েছিল, যাদের মধ্যে আশ্রয় পেয়েছিল শতাব্দীর সভ্যতার সবচেয়ে প্রগতিশীল কয়েকটি মতবাদ।’
কিন্তু তারাই তৎকালীন পাকিস্তানের প্রদেশ পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক বাহিনীর গুলিতে রক্তে রঞ্জিত হয়েছিলেন। রাজপথে অবহেলায় পড়েছিলো এইসব সূর্যসন্তানের মরদেহ।
কবি তাদের প্রসঙ্গে কবিতাটিতে আরো লিখেছেন, ‘ওরা চল্লিশজন কিংবা আরো বেশি যারা প্রাণ দিয়েছে ওখানে রমনার রৌদ্রদগ্ধ কৃষ্ণচূড়ার গাছের তলায় ভাষার জন্য, মাতৃভাষার জন্য; বাংলার জন্য। যারা প্রাণ দিয়েছে ওখানে একটি দেশের মহান সংস্কৃতির মর্যাদার জন্য আলাওলের ঐতিহ্য কায়কোবাদ, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সাহিত্য ও কবিতার জন্য; যারা প্রাণ দিয়েছে ওখানে পলাশপুরের মকবুল আহমদের পুঁথির জন্য-রমেশ শীলের গাথার জন্য, জসীমউদ্দীনের ‘সোজন বাদিয়ার ঘাটের’ জন্য। যারা প্রাণ দিয়েছে ভাটিয়ালি, বাউল, কীর্তন, গজল নজরুলের ‘খাঁটি সোনার চেয়ে খাঁটি আমার দেশের মাটি’; এ দুটি লাইনের জন্য, ওদের কারো নাম তোমারই মতো ওসমান, কারো বাবা তোমারই বাবার মতো হয়তো কেরানি, কিংবা পূর্ব বাংলার নিভৃত কোনো গাঁয়ে কারো বাবা মাটির বুক থেকে সোনা ফলায়, হয়তো কারো বাবা কোনো সরকারি চাকুরে। তোমারই আমারই মতো। যারা হয়তো আজকেও বেঁচে থাকতে পারতো, যাদের স্বপ্ন ছিল আইনস্টাইনের বৈজ্ঞানিক তত্ত্বকে আরো গভীরভাবে বিশ্লেষণ করার, যাদের স্বপ্ন ছিল আণবিক শক্তিকে কী ভাবে মানুষের কাজে লাগানো যায় তার সাধনা করার, যাদের স্বপ্ন ছিল রবীন্দ্রনাথের ‘বাঁশিওয়ালার’ চেয়েও সুন্দর একটি কবিতা রচনা করার, সেই সব শহীদ ভাইয়েরা আমার; যেখানে তোমরা প্রাণ দিয়েছ সেখানে হাজার বছর পরেও সেই মাটি থেকে তোমাদের রক্তাক্ত চিহ্ন মুছে দিতে পারবে না সভ্যতার কোনো পদক্ষেপ।’
আরও পড়ুন চুনতিতে ৬ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণে অমর একুশে বিতর্ক প্রতিযোগিতা
আজ সেই বর্বরতার ৭২ বছরে পদার্পন করছে বাঙালি জাতি। বাংলা ভাষাকে সংখ্যাগরিষ্ট পাকিস্তানীর রাষ্ট্রভাষা না করে সেদিন উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে ঘোষণা দেওয়ায় ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে রাজপথে মিছিলে নেমেছিলেন তারা। মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার আদায়ে মিছিলে নামা সেসব বাঙালিদের
পাকিস্তানি স্বেচ্ছাচারী শাসক তৎকালীন সামরিক বাহিনী লেলিয়ে হত্যা করেছিলো সেদিন। মিছিলটিতে ছাত্র, শিক্ষক, শিশু-কিশোরসহ নানা বয়সী মানুষ ছিলেন। এক অভূতপূর্ব অধ্যায় সংযোজিত হয়েছিলো সেদিন মানব ইতিহাসে। রক্তস্নাত সেই অমর একুশে আজ। আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসও। বাঙালি জাতি আজ সেদিনের সেইসব শহিদদের বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করছে। বাঙালি জাতির শোক ও গৌরবের দিন আজ। দিবসটি এখন আর শুধু বাঙালির নয়, পৃথিবীর সব ভাষাভাষী মানুষের। কয়েক হাজার ভাষায় কথা বলা কোটি কোটি মানুষ দিনটি শ্রদ্ধাভরে পালন করেন। অবশ্য যে বাঙালি জাতির রক্তে এ দিবস এসেছে তাদের কাছে দিনটির আবেদন অন্যরকমই। সেদিন রক্তে কেবল ভাষার অধিকার অর্জন হয়নি-স্বাধীনতার বীজও রোপিত হয়েছিলো। যার ফল আসে উনিশশো একাত্তরে। অমর একুশের পথ ধরেই উন্মেষ ঘটেছিল বাঙালির স্বাধিকার চেতনার। সেই আন্দোলনের সফল পরিণতি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন। ভাষার জন্য বাঙালির এই আত্মদানের দিনটিকে ১৯৯৯ সালে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা (ইউনেস্কো) ঘোষণা দিয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে। যার জন্য বাঙালির সঙ্গে সারা বিশ্ববাসী দিনটি পালন করবে মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা ও গৌরব বুকে নিয়ে।
শহিদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষ্যে রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন।
আজ সরকারি ছুটির দিন। সারা দেশের সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে অর্ধনমিত রাখা হবে জাতীয় পতাকা। একইসঙ্গে সর্বত্র ওড়ানো হবে শোকের কালো পতাকা। সংবাদপত্র, টেলিভিশন ও বেতারে ভাষা দিবসের বিশেষ ক্রোড়পত্র ও অনুষ্ঠানমালা প্রচার করা হচ্ছে। দিবসটি উপলক্ষ্যে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান নানা কর্মসূচি পালন করছে। এসব কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে শ্রদ্ধা নিবেদন, আলোচনাসভা, মিলাদ মাহফিল, কবর জিয়ারত ইত্যাদি।
Leave a Reply