সৈয়দ শিবলী ছাদেক কফিল: আইয়ুব বাচ্চু- একজন বিখ্যাত গায়ক, সুরকার ও গিটারিস্ট। তাঁর পুরো নাম মোহাম্মদ আইয়ুব বাচ্চু, ডাক নাম রবিন। এলআরবি ব্যান্ডের প্রতিষ্ঠাতা।
আইয়ুব বাচ্চুর পৈতৃক বাড়ি চট্টগ্রাম শহরের জুবিলী রোডে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর তাঁর বাবা এই এলাকায় একটি বাড়ি কেনেন, যেখানে বাচ্চুর শৈশব-কৈশোর-যৌবন কাটে। ঢাকার বাসা গুলশানে। তবে তিনি জন্মগ্রহণ করেন চট্টগ্রাম সদর দক্ষিণ মহকুমার পটিয়া থানার খরনা গ্রামে ১৯৬২ সালের ১৬ আগস্ট। তাঁর বাবার নাম মোহাম্মদ ইসহাক চৌধুরী এবং মায়ের নাম নুরজাহান বেগম। সপ্তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে অনুসন্ধানে বেরিয়ে অনেক অজানা তথ্য বা ইতিহাস। তাঁর দাদা বা পিতামহ মোহাম্মদ নুরুজ্জামান সওদাগর ছিলেন বিশিষ্ট সমাজসেবক, দানবীর ও প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। তিনি (মোহাম্মদ নুরুজ্জামান সওদাগর) বাংলাদেশের স্বাধীনতার কয়েক বছর আগে অর্থাৎ পাকিস্তান আমলের শেষ দিকে খরনাস্থ বাড়ির পাশে একটি বাজার স্থাপন করে। যার নাম নুরুজ্জামান সওদাগর বাজার।
আইয়ুব বাচ্চুর চাচা (বাবার চাচাতো ভাই) বয়োবৃদ্ধ আবদুল আজিজ জানান- এ এলাকার উত্তরে ছিল পটিয়া থানার বাজার (পুরাতন), পশ্চিমে অলির হাট, পূর্বে দীর্ঘ-দূর্গম পাহাড়ের পর রাঙ্গুনিয়া থানার অংশ বিশেষ ও দক্ষিণে গাছবাড়িয়া খানহাট ও কাঞ্চননগর রৌশনহাট। তাই অতি প্রয়োজনীয় নুরুজ্জামান সওদাগর স্থাপনে এলাকার জনগণের ব্যাপক সাড়া পায়। বাজারটি প্রতিষ্ঠার পরপরই জমজমাট হয়ে উঠে। এছাড়াও নুরুজ্জামান সওদাগর স্থানীয় মসজিদ, নুরুল মাদরাসা (নুরুল উলুম), মুসাফিরখানা, ইউনিয়ন বোর্ড (পরিষদ), কৃষি ব্লক সুপারভিশন অফিস, ইউনিয়ন ভূমি অফিস ইত্যাদির জন্য জমি দান করেন। তাঁর ছেলে (আইয়ুব বাচ্চুর) মোহাম্মদ ইসহাক চৌধুরীও ছিলেন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। ব্যবসা, পরিস্থিতি ও সময়ের প্রয়োজনে তিনি চট্টগ্রাম শহরে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করেন। তবে, তাঁর ভাইয়েরা পৈতৃক বাড়িতেই থাকেন।
আইয়ুব বাচ্চু ছিলেন বাংলাদেশের একজন কিংবদন্তী শিল্পী, যিনি একাধারে সঙ্গীত পরিচালক, সুরকার, গীতিকার এবং গিটারিস্ট হিসেবে জনপ্রিয় ছিলেন। তিনি “রূপালি গিটার” খ্যাত এবং এলআরবি (LRB) ব্যান্ডের প্রধান ভোকাল ও গিটারিস্ট হিসেবে ব্যাপক পরিচিত ছিলেন। তার সংগীত জীবন শুরু হয় ১৯৭৮ সালে “সোলস” ব্যান্ডের মাধ্যমে।
১৯৮০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে তিনি এলআরবি (LRB) ব্যান্ড গঠন করেন এবং এরপর থেকে এই ব্যান্ডের মাধ্যমেই তিনি বেশি পরিচিতি লাভ করেন।
জনপ্রিয়তা: “একদিন ঘুম ভাঙ্গা শহরে”, “চলো বদলে যাই”, “রূপালি গিটার”, “ঘুমন্ত শহরে”, “আমাদের বিস্ময়” সহ অসংখ্য জনপ্রিয় গান উপহার দিয়েছেন।
পুরস্কার ও স্বীকৃতি: তিনি তার কর্মজীবনে অসংখ্য পুরস্কার ও স্বীকৃতি লাভ করেন, যা তার প্রতিভার স্বীকৃতি বহন করে।
আইয়ুব বাচ্চুর সঙ্গীত দেশ ও দেশের বাইরে ব্যাপক সমাদৃত। তাঁর গান আজও মানুষের মনে গেঁথে আছে এবং তিনি বাংলা সঙ্গীত জগতে এক অবিচ্ছেদ্য নাম। ‘কষ্ট’ সহ তাঁর অনেক অ্যালবামের নাম ‘রবিন’ ছিল। তিনি আধুনিক এবং লোকগীতিতেও গান করেছেন, কিছু চলচ্চিত্রে তিনি প্লেব্যাকও করেছেন।
ব্যান্ড সংগীত: আইয়ুব বাচ্চু এলআরবি ব্যান্ড প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলা রক সঙ্গীতের একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেন। তাঁর ব্যান্ড দেশের বাইরেও জনপ্রিয়তা লাভ করে।
একক শিল্পী: তিনি ১৬টিরও বেশি একক অ্যালবাম প্রকাশ করেছেন এবং বহু জনপ্রিয় গান উপহার দিয়েছেন।
প্লেব্যাক: চলচ্চিত্রের গানেও তিনি অবদান রেখেছেন।
গীতিকার ও সুরকার: আইয়ুব বাচ্চু ছিলেন একজন প্রতিভাবান গীতিকার ও সুরকার। তিনি বহু গান লিখেছেন এবং সুর করেছেন, যা আজও মানুষের হৃদয়ে দাগ কাটে।
গিটারিস্ট: তার গিটার বাজানো ছিল অসাধারণ, এবং তিনি পরিচিত ছিলেন “রূপালি গিটার” ও “গীটারের জাদুকর” নামে ।
আইয়ুব বাচ্চু ১৯৯০ এর দশকের শেষদিকে সোলস থেকে বের হয়ে আসার পর ১৯৯১ সালে তিনি ঢাকায় যান এবং জানুয়ারিতে ফেরদৌস চন্দনাকে বিয়ে করেন, যার সাথে তাঁর ১৯৮৬ সাল থেকে সম্পর্ক ছিল। তিনি ‘”ইয়েলো রিভার ব্যান্ড”‘ নামের একটি ব্যান্ড গঠন করেন ৫ এপ্রিল ১৯৯১ সালে, এস আই টুটুল (কীবোর্ডস), সাইদুল হাসান স্বপন (বেজ গিটার) এবং হাবিব আনোয়ার জয় (ড্রামস)। ১৯৯১ সালের মাঝামাঝি সময়ে তাঁরা ভারতে অনুষ্ঠান করতে গেলে “লিটল রিভার ব্যান্ড” নামে পরিচিত করা হয়। নামটি বাচ্চু পছন্দ করে এবং আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁর ব্যান্ড নামকরণ করে। ১৯৯১ সালের এপ্রিল মাসে এলআরবি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের প্রথম কনসার্ট করে। ১৯৯২ সালের জানুয়ারি মাসে, তাঁরা বাংলাদেশে প্রথম ডাবল অ্যালবাম: এলআরবি -১ এবং এলআরবি -২ প্রকাশ করেছিল। ব্যান্ডটির তৃতীয় স্টুডিও অ্যালবাম সুখ, জুনে মুক্তি পায় এবং এটি বাংলাদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ রক অ্যালবামগুলির মধ্যে একটি হিসাবে বিবেচিত হয়। এতে “চলো বদলে যাই” গানটি ছিল যা বাচ্চুর সর্বশ্রেষ্ঠ কাজ হিসাবে বিবেচিত। ১৯৯০ এর দশকে আরও কয়েকটি অ্যালবাম প্রকাশ হয় এবং দ্রুত বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় রক ব্যান্ডের মধ্যে একটি হয়ে ওঠে। ১৯৯৬ সালে, তারা ব্যাঙ্গালোরে অনুষ্ঠান করেছিল, যা বাংলাদেশের বাইরে তাদের প্রথম কনসার্ট ছিল। এলআরবি নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেন অনুষ্ঠান করা প্রথম ও একমাত্র বাংলাদেশী ব্যান্ড গ্রুপ।
আইয়ুব বাচ্চুর স্ত্রী ফেরদৌস আক্তার চন্দনা এবং তাদের দুই সন্তান ফাইরুজ সাফরা আইয়ুব ও আহনাফ তাজওয়ার আইয়ুব রয়েছেন। আইয়ুব বাচ্চুর মৃত্যুর পর স্ত্রী এবং সন্তানরা তাঁর স্মৃতি ও গান সংরক্ষণের জন্য কাজ করছেন।
স্ত্রী ফেরদৌস আক্তার চন্দনা সাধারণত মিডিয়া থেকে দূরে থাকেন। তবে তিনি তাঁর স্বামীর গান এবং স্মৃতি সংরক্ষণে সক্রিয়ভাবে কাজ করছেন। তিনি সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে আইয়ুব বাচ্চুর গান এবং স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য একটি ফাউন্ডেশন তৈরির উদ্যোগ নিয়েছেন। তাঁদের দুই সন্তা ফাইরুজ সাফরা আইয়ুব এবং আহনাফ তাজওয়ার আইয়ুব- দুজনেই প্রাপ্তবয়স্ক এবং তাঁরা তাঁদের বাবার স্মৃতি ও গান সংরক্ষণে কাজ করছেন।
আইয়ুব বাচ্চু ২০১৮ সালের ১৮ অক্টোবর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। চট্টগ্রাম জমিয়াতুল ফালাহ মসজিদ প্রাঙ্গণে তাঁর জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। স্টেশন রোডের চৈতন্য গলি কবরস্থানে মায়ের কবরের পাশে তাঁকে দাফন করা হয়।
Leave a Reply