আজ ২৯শে আশ্বিন, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ১৪ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

আহমদ ছফা- বাংলা সাহিত্যে এক বিখ্যাত নাম


সৈয়দ শিবলী ছাদেক কফিল: “আমি তোমার পাঠশালাতে-পাঠ নিয়েছি শব্দ ধ্বনির। রঙ লেগেছে চোখের তারায়, স্বাদ পেয়েছি কথার ননীর।”

বাংলা সাহিত্য জগতে এক বিখ্যাত নাম “আহমদ ছফা”। যিনি “সাহিত্যিক আহমদ ছফা” নামে বেশী পরিচিত। তিনি ছিলেন একজন বাংলাদেশী লেখক, ঔপন্যাসিক, কবি, চিন্তাবিদ ও বুদ্ধিজীবী। তিনি বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে গভীর প্রভাব ফেলেছিলেন ষাটের দশক থেকে শুরু করে মৃত্যু পর্যন্ত।

আহমদ ছফার জন্ম ৩০ জুন ১৯৪৩ সালে চট্টগ্রামের চন্দনাইশের গাছবাড়িয়ায়। তাঁর পিতার নাম হেদায়েত আলী এবং মাতার নাম আছিয়া খাতুন। তিনি দুই ভাই ও চার বোনের মধ্যে দ্বিতীয় ছিলেন।

আহমদ ছফার ব্যক্তিগত জীবন ছিল বৈচিত্র্যময়। তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয় পিতার প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দক্ষিণ গাছবাড়িয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে নিজের গ্রামের নিত্যানন্দ গৌরচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। ছাত্রাবস্থায় সুধাংশু বিমল দত্তের মাধ্যমে কৃষক সমিতি-ন্যাপ বা তৎকালীন গোপন কমিউনিস্ট পার্টির সাথে যুক্ত হন। মাস্টারদা সূর্যসেনের বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে অণুপ্রাণিত হয়ে তাঁরা কয়েকজন বন্ধু মিলে চট্টগ্রাম-দোহাজারী রেললাইন উপড়ে ফেলেন। পরে গ্রেপ্তার এড়াতে কিছুকাল পার্বত্য চট্টগ্রামে আত্মগোপন করেন। ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম নাজিরহাট কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন, একই বৎসরে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে। যদিও পরে বাংলা বিভাগে ক্লাশ করা অব্যাহত রাখেননি। ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজ থেকে প্রাইভেটে পরীক্ষা দিয়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে এমএ পরীক্ষা দেয়ার আগেই বাংলা একাডেমির পিএইচডি গবেষণা বৃত্তির জন্য আবেদন করেন এবং তিন বছরের ফেলোশিপ পান। গবেষণার বিষয় ছিল ‘১৮০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব, বিকাশ এবং বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে তার প্রভাব’। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে পিএইচডি অভিসন্দর্ভের জন্য জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের সান্নিধ্যে আসেন। দীর্ঘকাল তাদের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় থাকে। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে প্রাইভেটে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ পরীক্ষা দেন। ১৯৭১ সালে ‘লেখক সংগ্রাম শিবির’ গঠন ও এর বিভিন্ন কার্যক্রমে সক্রিয় অংশ নেন। ‘স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পত্রিকা’ হিসেবে প্রতিরোধগ্ধ প্রকাশ করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন এপ্রিল মাসে কলকাতা চলে যান। মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে সেখান থেকে দাবানলগ্ধ নামের পত্রিকা সম্পাদনা করেন। দেশ স্বাধীন হবার পর বাংলাদেশে ফিরে লেখালেখি করতে থাকেন।

১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে দৈনিক ইত্তেফাকের সাংবাদিক নাজিমুদ্দিন মোস্তানের সহায়তায় কাঁটাবন বস্তিতে ‘শিল্পী সুলতান কর্ম ও শিক্ষাকেন্দ্র’ চালু করেন। পরে ১৯৮৬-তে জার্মান ভাষার ওপর গ্যেটে ইনস্টিটিউটের ডিপ্লোমা ডিগ্রিও লাভ করেন তিনি, যা তাঁকে পরবর্তী সময়ে গ্যেটের অমর সাহিত্যকর্ম ফাউস্ট অনুবাদে সহায়তা করেছিল।
তাঁর কর্মজীবন শুরু হয় ষাটের দশকে। তিনি বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকায় লেখালেখি করতেন এবং দ্রুত তাঁর কাজের জন্য পরিচিতি লাভ করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনার মধ্যে রয়েছে উপন্যাস, প্রবন্ধ, কবিতা, ও আত্মজীবনী।

আহমদ ছফার সাহিত্যকর্মের বৈশিষ্ট্য হলো- তিনি সমাজের বঞ্চিত ও প্রান্তিক মানুষের কথা তুলে ধরেন। তাঁর লেখায় রাজনৈতিক ও সামাজিক অসঙ্গতি, শ্রেণি বৈষম্য এবং স্বৈরাচারিতার বিরুদ্ধে সোচ্চার কথন। সংগ্রামী চেতনা, আপোষহীন মনোভাবর এবং জীবন ঘনিষ্ঠ সাহিত্যের অমর মানুষটি আজও অগণন পাঠকের হৃদয়ে বেঁচে আছেন।
তাঁর লেখা উপন্যাস, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, কবিতা ইত্যাদির মধ্যে উল্লেখযোগ্য রচনা বই হল- বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস (১৯৭২), বাঙালি মুসলমানের মন (১৯৮১)
ওঙ্কার (১৯৭৫), একজন আলী কেনানের উত্থান-পতন (১৯৮৮, অলাতচক্র (১৯৯৩, গাভী বিত্তান্ত (১৯৯৫) অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী (১৯৯৬), পুষ্প বৃক্ষ এবং বিহঙ্গ পুরাণ (১৯৯৬), যদ্যপি আমার গুরু (১৯৯৮), ফাউস্ট (১৯৮৬), আত্মজীবনী: আহমদ ছফার আত্মদর্শন, অপেক্ষা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস প্রবন্ধগ্রন্থে আহমদ ছফা বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের মানচিত্র অঙ্কন করেন এবং বাংলাদেশী বুদ্ধিজীবিদের সুবিধাবাদিতার নগ্নরূপ উন্মোচন করেন তথা বুদ্ধিজীবিদের সত্যিকার দায়িত্বের স্বরূপ ও দিকনির্দেশনা বর্ণনাপূর্বক তাদের সতর্ক করে দিতে বুদ্ধিজীবিদের ব্যর্থতায় বাংলাদেশের কী দুর্দশা হতে পারে তা সম্পর্কে ভবিষ‍্যদ্বাণী করেন। আহমদ ছফা তাঁর বিখ্যাত “বাঙালি মুসলমানের মন” (১৯৭৬) প্রবন্ধে বাঙালি মুসলমানের আত্মপরিচয়ের হাজার বছরের বিবর্তন বিশ্লেষণপূর্বক তাদের পশ্চাদগামিতার কারণ অনুসন্ধান করেছেন। আনিসুজ্জামান ও সলিমুল্লাহ খানসহ আরো অনেকে ছফার বাঙালি মুসলমানের মন (১৯৮১) প্রবন্ধ সংকলনটিকে বাংলা ভাষায় রচিত গত শতাব্দীর ‘সেরা দশ চিন্তার বইয়ের’ একটি বলে মনে করেন।

তাঁর রচিত প্রতিটি উপন্যাসই ভাষিক সৌকর্য, বিষয়বস্তু ও রচনাশৈলীর অভিনবত্বে অনন্য। মানসিক, সাংস্কৃতিক ও আর্থসামাজিক সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অনুষঙ্গসহ আহমদ ছফার চরিত্র সৃষ্টির তথা কাহিনী কথনের পারঙ্গমতা অসামান্য। আবুল ফজল ও আরো অনেকের মতে “ওঙ্কার” বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সর্বোত্তম সাহিত্যিক বহিঃপ্রকাশ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে রচিত গাভী বিত্তান্তে বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ ব্যঙ্গাত্মক উপন্যাসগুলোর একটি। পুষ্প বৃক্ষ ও বিহঙ্গ পুরাণ-এ ঢাকা শহরের প্রেক্ষিতে ফুল, পাখি, বৃক্ষ তথা বৃহৎ প্রকৃতির সাথে মানুষের সম্পর্কের এক নিজস্ব বয়ান হাজির করেন।

আহমদ ছফা ও তার রচনাকর্ম অনেক লেখক, শিল্পী, চলচ্চিত্রকার ও বুদ্ধিজীবীকে অনুপ্রাণিত করেছে; তাঁদের মাঝে অন্যতম হুমায়ূন আহমেদ, ফরহাদ মজহার, মুহম্মদ জাফর ইকবাল, তারেক মাসুদ এবং সলিমুল্লাহ খান। বর্তমানে ছফা স্বাধীন বাংলাদেশের সর্বোত্তম ও সর্বশ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবি বলে বিবেচিত।

জীবিতকালে আহমদ ছফা তাঁর প্রথাবিরোধিতা, স্পষ্টবাদিতা, স্বকীয় দৃষ্টিভঙ্গির জন্য লেখক ও বুদ্ধিজীবী মহলে বিশেষ আলোচিত ও বিতর্কিত ছিলেন। জীবদ্দশায় অনেকে তাঁকে বিদ্রোহী, বোহেমিয়ান, উদ্ধত, প্রচলিত ব্যবস্থার প্রতি শ্রদ্ধাহীন ও বিতর্কপ্রবণ বলে অভিহিত করেছেন। দেশবরেণ্য ও বিখ্যাত সাহিত্যিক আহমদ ছফা ২০০১ সালের ২৮ জুলাই মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে মিরপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়। বাংলাদেশ সরকার ২০০২ সালে তাঁকে সাহিত্যে মরণোত্তর একুশে পদক প্রদান করেন।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     এই বিভাগের আরও খবর