আজ ২৯শে বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ১২ই মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

৫২ লাখ টাকার ইলিশ নিয়ে মহেশখালীতে তোলপাড়


# জব্দ করা হয় ১৩ হাজার ৫০০ পিস ইলিশ ও ৮৫ কেজি অন্যান্য প্রজাতির মাছ
#৮ হাজার ১০০ কেজি ইলিশের মধ্যে নিলাম দেওয়া হয় ১১৫০ কেজি
#৩২টি মসজিদ, মাদ্রাসা ও বিভিন্ন ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিতরণ করা হয়েছে ৪০০ কেজি
# প্রায় ৫২ লাখ ৪০ হাজা টাকা মূল্যের ৬ হাজার কেজির বেশি ইলিশের কোনো হদিস নেই
# মাছ গুলো গোপনে জব্দকৃত বোটেই রেখে লাখ লাখ টাকার বিনিময়ে বোটগুলো ছেড়ে দেওয়ার অভিযোগ সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা সাহাদুল ইসলামের বিরুদ্ধে

আবদুর রাজ্জাক, জেলা প্রতিনিধি, কক্সবাজার ।।কক্সবাজারের মহেশখালীতে নৌবাহিনীর অভিযানে জব্দ করা বিপুল পরিমাণ ইলিশ মাছ লোপাটের অভিযোগ উঠেছে উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা সাহাদুল ইসলামের বিরুদ্ধে। প্রায় ৫২ লাখ ৪০ হাজার টাকার ৬ হাজার কেজির বেশি ইলিশের কোনো হদিস মিলছে না বলে অভিযোগ উঠেছে, যা নিয়ে স্থানীয় পর্যায়ে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। ঘটনার পর থেকে মৎস্য কর্মকর্তার দেওয়া তথ্যেও গরমিল পাওয়া গেছে।ঘটনার সূত্রপাত গত ৭ মে রাতে। বঙ্গোপসাগরে অভিযান চালিয়ে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর একটি বিশেষ দল ৬টি ফিশিং বোট থেকে ১৩ হাজার ৫০০ পিস ইলিশ, ৮৫ কেজি অন্যান্য প্রজাতির মাছ এবং ৪ লাখ ৫৫ হাজার মিটার কারেন্ট জাল জব্দ করে। এ সময় ১০৩ জন মাঝিমাল্লাকেও আটক করা হয়। নৌবাহিনীর এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, জব্দ করা জাল ও মাছ মহেশখালী কোস্টগার্ড স্টেশনে হস্তান্তর করা হয়। তবে বিপত্তি বাধে পরদিন, ৮ মে। মহেশখালী উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তার অফিসিয়াল ফেসবুক আইডি থেকে দেওয়া এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে পুরো বিষয়টি ধোঁয়াশার চাদরে ঢেকে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ। সেখানে উল্লেখ করা হয়, জব্দকৃত মাছের মধ্যে মাত্র ১১৫০ কেজির মতো নিলামে বিক্রি করে বাকি মাছ ৩২টি মসজিদ, মাদ্রাসা ও বিভিন্ন ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিতরণ করা হয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে জব্দকৃত মাছের মোট পরিমাণের কোনো সঠিক উল্লেখ না করে কেবল নিলামের ১১৫০ কেজির কথাই বলা হয়। স্থানীয় পর্যবেক্ষকদের মতে, বিতরণ করা মাছের পরিমাণ বড়জোর ৪০০ কেজি হতে পারে। এছাড়া, ৬টি ফিশিং বোটের মালিককে ৭ লাখ ২০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।

নৌবাহিনীর তথ্য অনুযায়ী, ১৩ হাজার ৫০০ পিস ইলিশের গড় ওজন ৬০০ গ্রাম ধরলে মোট মাছের পরিমাণ দাঁড়ায় ৮ হাজার ১০০ কেজি। এর মধ্যে ১১৫০ কেজি নিলামে এবং প্রায় ৪০০ কেজি বিতরণ করা হলে বাকি ৬ হাজার ৫৫০ কেজি ইলিশের কোনো হিসাব মিলছে না। অথচ মৎস্য কর্মকর্তা সাহাদুল ইসলাম তার ফেসবুক পোস্টে প্রথমে প্রায় ১১ হাজার কেজি মাছের কথা উল্লেখ করেছিলেন। স্থানীয় সচেতন মহলের অভিযোগ, মৎস্য দপ্তরের নিলাম ও মাছ বিতরণ কার্যক্রম ছিল নাটকীয় ও বর্তমান বাজারদর অনুযায়ী, প্রতি কেজি ইলিশ ৮০০ টাকা হলে ৮ হাজার ১০০ কেজি মাছের মোট মূল্য দাঁড়ায় ৬৪ লাখ ৮০ হাজার টাকা। কিন্তু মৎস্য অফিস নিলাম ও জেরিমানা বাবদ মাত্র ১১ লাখ ৮১ হাজার টাকার হিসাব দিতে পারছে। বাকি ৫২ লাখ ৪০ হাজার টাকার মাছ (৬ হাজার ৫৫০ কেজি) কোথায় গেল, এ প্রশ্নের জবাবে সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা সাহাদুল ইসলাম দায়সারাভাবে জানান, নৌবাহিনীর দেওয়া মাছ তারা আনুমানিক ১১ হাজার কেজি হিসেবে ফেসবুকে লিখেছিলেন। স্থানীয় একাধিক সূত্র অভিযোগ করেছে, এই বিপুল পরিমাণ মাছ গোপনে জব্দকৃত বোটেই রেখে লাখ লাখ টাকার বিনিময়ে ‘ম্যানেজ’ করে বোটগুলো ছেড়ে দিয়েছেন সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা সাহাদুল ইসলাম ও কোস্টগার্ডের কতিপয় কর্মকর্তা।

এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট এক নৌ কর্মকর্তা জানান, তারা জব্দকৃত মাছ কোস্টগার্ড ও উপজেলা মৎস্য অফিসের কাছে বুঝিয়ে দিয়েছেন। এরপর নিলাম ও বিতরণের সম্পূর্ণ দায়ত্বি ছিল মৎস্য কর্মকর্তার। জানা গেছে, মাছ নিলামের সময় সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা উপস্থিত থাকলেও জব্দকৃত মাছের কোনো পূর্ণাঙ্গ সরকারি ওজন রেকর্ড করা হয়নি, যা পুরো প্রক্রিয়াকে আরও সন্দেহজনক করে তুলেছে।শুধু মাছই নয়, জব্দকৃত সাড়ে ৪ লাখ মিটার কারেন্ট জালের একটি বড় অংশও গোপনে বিক্রি করে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে উপজেলার কুতুবজোম ইউনিয়নের এক মাছ ব্যবসায়ী জানান, তিনিও কিছু জাল কিনতে আগ্রহী ছিলেন, কিন্তু ‘সঠিক লবিং’ করতে না পারায় পারেননি। তার মতে, ভেতরের লোকদের মাধ্যমেই জাল বিক্রি হয়েছে, বাইরে কাউকে সুযোগ দেওয়া হয়নি। তবে সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা সাহাদুল ইসলাম। তার দাবি, নৌবাহিনী আমাদের ১৩ হাজার ৫০০ পিস ইলিশ বুঝিয়ে দিয়েছে বললেও আমরা বাস্তবে অতগুলো পাইনি। তিনি আরও বলেন, যেটুকু মাছ হাতে এসেছে, তা নিয়ম মেনেই প্রকাশ্যে নিলাম ও বিতরণ করা হয়েছে। মাছের গড় ওজন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যা পেয়েছি তা হয়তো গড়ে ৬০০ গ্রাম হবে। বোটে মাছ রেখে ছেড়ে দেওয়ার অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এ ধরনের কোনো সুযোগ নেই, যা পেয়েছি তাই প্রশাসনের উপস্থিতিতে সরাসরি খরচ করেছি। তবে এসব দাবির স্বপক্ষে কোনো প্রকার লিখিত হিসাব বা দাপ্তরিক রেকর্ড দেখাতে পারেননি তিনি।

মৎস্য কর্মকর্তার এসব বক্তব্যে অসঙ্গতি রয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট মহল। জব্দকৃত মাছের পরিমাণ যদি নৌবাহিনীর প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকে, তবে মৎস্য কর্মকর্তার তা অস্বীকার করা এবং কোনো দাপ্তরিক প্রমাণ দেখাতে না পারা পুরো ঘটনাকে আরও রহস্যময় করে তুলেছে।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     এই বিভাগের আরও খবর