আবদুর রাজ্জাক, জেলা প্রতিনিধি, কক্সবাজার।। সুগন্ধার সেই আলোচিত সরকারি জায়গায় অভিযান পরিচালনা করছেন দুর্নীতি দমন কমিশন ( দুদকে'র) একটি টিম। এর আগে সুগন্ধার ও-ই জায়গায় দুদকের ঠিম পৌঁছালে ভিতরে ও বাইরে তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। ভিতরে সাড়াশব্দ থাকলে-ও কেউ দরজা না খোলায় অনেকটা ক্ষুব্ধ হয় দুদকের সদস্যরা। পরে অনেকটা জোর করেই প্রবেশ করতে হয়েছে দুদকের অভিযানিক দলকে। গতকাল সোমবার (৫ এপ্রিল) সকাল সাড়ে ১১ টার দিকে শহরের সুগন্ধার কয়েকশো কোটি টাকার সরকারি জমি জাল খতিয়ানে দখলের পায়তারার অভিযোগ পেয়ে দুদকের একটি টিম অভিযানে যায়। অভিযানের নেতৃত্ব দেওয়া সহকারী পরিচালক ( দুদক) অনিক বড়ুয়া জানান, গত কয়েকদিন থেকে সুগন্ধার সরকারি একটি জায়গা নিয়ে জাতীয় এবং স্থানীয় গণমাধ্যমে সংবাদ প্রচারের বিষয়টি নজরে আসে। এছাড়া ওই জায়গা সম্পূর্ণ সরকারি একটি জায়গা। কিছু অসাধু ব্যাক্তি উক্ত জায়গা দখল করে মার্কেট নির্মাণ করে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন। শুধু তাই নয়, ও-ই জায়গা যে ব্যাক্তি নিজের মালিকানাধীন জায়গা বলে দাবি করছে তাকে নিয়ে ও যথেষ্ট সন্দেহ আছে। এরকম অভিযোগে পেয়ে আমাদের একটি টিম অভিযান যায়। কিন্তু অনেক্ক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকেও দরজা খুলতে পারিনি। পরে গণমাধ্যম কর্মীরাসহ দরজা খুলতে সক্ষম হই। এদিকে ও-ই সময় দুদকের অভিযানের খবর পেয়ে সংবাদ কাভার করতে উপস্থিত হয় বিভিন্ন গণমাধ্যমে কর্মরত সাংবাদিকেরা। সাংবাদিক দেখে ক্ষিপ্ত হয় সেখানে দায়িত্বরত কেয়ারটেকার শিমুল। তার কাছে জানতে চাইলে, তিনি বলেন, আমিসহ নয়ন ও কাজল বড়ুয়া এই জায়গার দেখভালের দায়িত্ব আছি। কে বা কারা তাঁদের দায়িত্ব দিয়েছেন এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ' সচ্চিদানন্দ সেন গুপ্তের লোকের নির্দেশে তারা কাজ করছেন। এখানে আর কে বা কারা জড়িত আছে জানতে চাইলে তিনি কোন উত্তর না দিয়ে পাশ কেটে যায়।ঘটনাস্থলে উপস্থিত সাংবাদিকরা জানান, দুদকের অভিযানের খবর পেয়ে সেখানে উপস্থিত হয় সাংবাদিকেরা। কিন্তু সংবাদকর্মীদের দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে শিমুল। ও-ই সময় তার হাতে একটি অস্ত্র সদৃশ বস্তুু দেখা যায় বলে দাবি করেছেন সাংবাদিকেরা। জানা যায়, ১৯৯৯ সালের ১৯ এপ্রিল সরকার টেকনাফ থেকে নাজিরার টেক পর্যন্ত এলাকাকে পরিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা ( ইসিএ) হিসেবে ঘোষণা করেন। পরবর্তীতে ২০১১ সালে উচ্চ আদালতের এক রায়ে কলাতলীর হোটেল-মোটেল জোনের ৪৯টি প্লট একসাথে বাতিল করে। এরপর ২০১৮ সালে আরেকটি রায়ে হোটেল -মোটেল জোন এলাকাসহ ১ নং খাস খতিয়ানে অন্তর্ভুক্ত করেন। বিশেষ ২০০০৩ দাগের ৩৯ দশমিক ৭৮ একর জমি সম্পূর্ণভাবে খাস হয়ে যায়। সচ্চিদানন্দ সেনের দাবিকৃত সুগন্ধার সেই আলোচিত জমির ২ দশমিক ৩ একর জায়গায় সরকারের ১ নং খাস খতিয়ানের জায়গা।জেলা প্রশাসন জানিয়েছেন, ২০০০৩ দাগের সম্পূর্ণ জমি সরকারের ১ নং খাস খতিয়ানের জায়গা। বাতিলকৃত প্লটের ২ একর ৩০ শতক খাস জমি সচ্চিদানন্দ সেনগুপ্ত নামের এক ব্যক্তির জমি দাবি করে জাল কাগজপত্র বানিয়ে রাতারাতি মার্কেট নির্মাণের কাজ শুরু করে হাইকোর্টের দোহাই দিয়ে। তাদের সেই রায়ের বিরুদ্ধে সরকার পক্ষ সুপ্রীম কোর্টে আপিল করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ আদালত স্থিতিবস্থা জারি করেন। অনিক বড়ুয়া আর-ও বলেন, 'খাসজমি দখল করে দোকানঘর নির্মাণের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেছে। একটি চক্র সরকারি খাস খতিয়ানের আড়াই একর জমি জাল দলিল ও খতিয়ান তৈরি করে শতাধিক দোকানঘর নির্মাণ করেছে। যেখানে থেকে ওই চক্র ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে দোকান বরাদ্দের নামে কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। অনিক বড়ুয়া বাবু আরও বলেন, সরকারি জমি দখলদারের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। একই সঙ্গে জাল খতিয়ান ও দলিল তৈরির মদদদাতা প্রভাবশালী ব্যক্তি বা সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত থাকলে, তাঁদের আইনের আওতায় আনা হবে।কউকের উপ-নগর পরিকল্পনাবিদ তানভীর হাসান রেজাউল বলেন, সচ্চিদানন্দ সেন নামের ওই ব্যাক্তি২০২৪ সালের ৩০ জানুয়ারি ওই জমি ব্যবহারের জন্য কউক বরাবর আবেদন করেন। কিন্তু কাগজ যাচাই-বাছাই করতে গিয়ে দেখা সব কাগজই ভুয়া এবং নথি জালিয়াতির বিষয়টি স্পষ্ট হয়। এর পর ২০২৪ সালের ১২ জুন জেলা প্রশাসন ও ভূমি অফিসের কাছে এক চিঠি দেন এবং ওই চিঠিতে ভুয়া কাগজপত্র ও সরকারের নথি জালিয়াতি করার কারনে সচ্চিদানন্দ সেনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়। জাল খতিয়ানে স্বাক্ষর রয়েছে কক্সবাজার সদর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) আরিফ উল্লাহ নিজামীর। তুলনাকারক হিসেবে ভূমি অফিসের নাজির মোহাম্মদ আলমগীর ও নকলকারক হিসেবে কর্মচারী মোহাম্মদ আয়াছের স্বাক্ষর আছে। পরে ভুমি অফিসের তৎকালীন সহকারী কমিশনার ( ভুুমি) আরিফ উল্লাহ নিজামী তার বিরুদ্ধে সদর থানায় একটি জিডি করে এবং পরবর্তীতে সেটি মামলায় রুপান্তরিত হয়। এ বিষয়ে তিনি আরিফ উল্লাহ নিজামী বলেন, 'আমাদের স্বাক্ষর জাল করে খতিয়ান সৃজন করে একটি চক্র সরকারি জায়গাটি দখল করতে চেয়েছে। আমি বিষয়টি জানার পর সাথে সাথে সদর মডেল থানায় একটি জিডি করি। তিনি বলেন, ওই ব্যাক্তিকে আমি জীবনেও চোখে দেখিনি। তার সাথে জাল জালিয়াতির একটি বিশাল চক্র জড়িত আছে'।কক্সবাজার সদর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) শারমিন সুলতানা জানান, জাল কাগজ বানিয়ে সরকারি খাস জমি দখলের বিষয়টি জেলা প্রশাসনের নজরে আসার পর সচ্চিদানন্দ সেনগুপ্তসহ দুইজনের বিরুদ্ধে সদর থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এ ছাড়া ভূমি অফিসের রেকর্ডপত্র দেখে, সচ্চিদানন্দ সেনগুপ্ত নামে কোনো ব্যক্তির খতিয়ানের অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যায়নি। কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের তৎকালীন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ( রাজস্ব) বিভীষণ কান্তি দাশ বলেন, সচ্চিদানন্দ সেনের পক্ষে একটি চক্র জাল খতিয়ান করে সরকারের জমি দখলে নিতে মরিয়া হয়ে ওঠেছে। সচ্চিদানন্দ সেনের নামে কোনো খতিয়ান নেই। আমি থাকাকালীন তাঁদের কাগজপত্র ঘেঁটে দেখেছি। সব কাগজেই গরমিল রয়েছে। আমি সবকিছু যাচাই-বাছাই করে প্রতিবেদন জমা দিয়েছি। যেখানে ও-ই ব্যাক্তির কোন জায়গায় নেই এবং এই জায়গা মালিক সরকার। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) নিজাম উদ্দিন আহমেদ বলেন,‘ সরকারি খাস জমি দখলের বিষয়টি নজরে আসার পর সবধরণের স্থাপনা সরিয়ে নিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। শিগগিরই না সরালে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হবে।
জেলা প্রশাসক মো সালাহউদ্দিন বলেন, তাঁদেরকে সময় দেওয়া হয়েছে স্থাপনা সরিয়ে নেওয়ার জন্য। শুনেছি এখনো স্থাপনা সরানো হয়নি। শিগগিরই না সরালে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হবে।