আজ ৩১শে বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ১৪ই মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

গর্জনিয়া-নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের অঘোষিত সম্রাট যুবলীগ নেতা ডাকাত শাহীনের নিয়ন্ত্রণে চলে সীমান্ত চোরাচালান


# স্বাধীন দেশের পরাধীন এক ভূখণ্ড গর্জনিয়া-নাইক্ষ্যংছড়ি
# যেখানে আইন, প্রশাসন, সরকার সব কিছুই ডাকাত শাহীন 
# সশস্ত্র প্রশিক্ষণের জন্য ভাড়ায় আনা হয় সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত সেনা সদস্যদের
#গত ২৫ ফেব্রুয়ারি রাতে ভাড়ায় আনা নরসিংদীর সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত বিকচাঁন মিয়াকে ডাকাতির প্রস্তুতিকালে নাইক্ষ্যংছড়ি থানা পুলিশ অস্ত্র ও গুলিসহ গ্রেপ্তার করে।
# গর্জনিয়া পুলিশ ফাঁড়ির আইসি ডাকাত শাহীনের কাছ থেকে নিয়মিত মাসোহারা নেয়
#ডাকাত শাহীন কে প্রশাসনিকভাবে শেল্টার দেয় কক্সবাজারের কথিত ৫ দিন সাংবাদিক
# সীমান্ত দিয়ে গরু-মহিষ পার করতে কাজ করছে আন্তর্জাতিক মাফিয়া সহ দেশের শীর্ষ সন্ত্রাসীরা
#গর্জনিয়ার অর্ধ শতাধিক পরিবারের প্রায় দুই শতাধিক মানুষ শাহীনের ভয়ে এলাকা ছাড়া।

আবদুর রাজ্জাক, জেলা প্রতিনিধি,কক্সবাজার  ।। গর্জনিয়া ও নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের অঘোষিত সম্রাট ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের দোসর এমপি কমলের সন্ত্রাসী বাহিনীর প্রধান যুবলীগ নেতা শাহীনুর রহমান শাহীন ওরফে ডাকাত শাহীনের নিয়ন্ত্রণে চলে সীমান্ত চোরাচালান । তাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ সীমান্ত এলাকার লোকজন। তার বাহিনীর ভয়ে কেউ মুখ খোলার সাহস পাচ্ছে না। ফলে বান্দরবানের নাইক্ষংছড়ি ও কক্সবাজারের রামু উপজেলায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করছে ডাকাত শাহীন বাহিনী। রামু উপজেলার দুই বিচ্ছিন্ন ইউনিয়ন গর্জনিয়া ও কচ্ছপিয়াসহ পার্বত্য বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিন অবৈধভাবে আসছে শত শত মিয়ানমারের গরু – মহিষ। যাচ্ছে চাল, ডাল, তেল, ওষুধ ও বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সামগ্রী। সীমান্ত লাগোয়া এই জনপদ এখন ইয়াবা, আইস, অস্ত্র ও স্বর্ণ চোরাচালানের নিরাপদ রুট। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দেওয়া তথ্যানুযায়ী দেশের শীর্ষ সন্ত্রাসী, অস্ত্র কারিগর, অস্ত্র প্রশিক্ষকসহ অপরাধী চক্রের বিচরণ ক্ষেত্র এসব পাহাড়ি জনপদ। শুধু তাই নয়, রোহিঙ্গা বিদ্রোহী ও আরাকান আর্মির সঙ্গে সখ্যতা গড়ে পুরো সীমান্ত এলাকাকে অশান্ত করার পাঁয়তারা চালাচ্ছে তারা। এসবের নেতৃত্ব দিচ্ছে রামু কচ্ছপিয়ার সন্ত্রাসী জামসেদ ও গর্জনিয়ার ডাকাত সর্দার শাহীন।খুন, অস্ত্র চোরাচালান ও গরু পাচারসহ ৪টি মামলার পলাতক আসামি জামসেদ এবং অপরদিকে ডাকাত শাহীনের বিরুদ্ধে রামু ও নাইক্ষ্যংছড়ি থানায় রয়েছে ২০ টি মামলা। সর্বশেষ ডাকাত শাহীন ভাড়ায় আনা নরসিংদীর সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত বিকচাঁন মিয়া (৩৪)কে সোনাইছড়ি জারুলিয়াছড়ি থেকে গত মঙ্গলবার ২৫ ফেব্রুয়ারি রাত অনুমান সাড়ে ১২টায় গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ডাকাতির প্রস্তুতিকালে নাইক্ষ্যংছড়ি থানা পুলিশ অস্ত্র ও রাইফেলের গুলিসহ গ্রেপ্তার করে। জানা গেছে, সশস্ত্র প্রশিক্ষণের জন্য ভাড়ায় আনা হয়েছিল বিকচাঁনকে। এই মামলায় ডাকাত শাহীনসহ অন্তত ৬ জন এবং অজ্ঞাত আরও তিনজনকে আসামি করা হয়েছে। অন্যদিকে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি (বুধবার) ভোর ৬টায় নাইক্ষ্যংছড়ি সদর ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের বামহাতিরছড়া ব্রিজের উপর থেকে ১১টি মিয়ানমার থেকে সীমান্ত পার করে চোরাই পথে আসা ১১টি বলদ গরু জব্দ করে পুলিশ। এ সময় গরুর সঙ্গে থাকা প্রাপ্তবয়স্ক ওবাইদুল হক ও জসিম উদ্দিন নামে দুই পাচারকারীসহ ৯ শিশুকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাদের দেওয়া স্বীকারোক্তিতে উঠে আসে পাচার করে আনা গরুর মালিক জামসেদের নাম। ফলে এই মামলায় তাকেও আসামি করা হয়েছে।খুন, অস্ত্র চোরাচালান ও গরু পাচারসহ ৪টি মামলার পলাতক আসামি জামসেদ এবং অপরদিকে ডাকাত শাহীনের বিরুদ্ধে রামু ও নাইক্ষ্যংছড়ি থানায় রয়েছে ১৭টি মামলা।একাধিক জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয়দের অভিমত পাহাড়ি সীমান্তবর্তী দুর্গম জনপদের ত্রাস হচ্ছে ডাকাত শাহীন ও জামসেদ। তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে সব ধরনের অপরাধ ও অবৈধ বাণিজ্য। সীমান্ত দিয়ে গরু-মহিষ পার করতে কাজ করছে আন্তর্জাতিক মাফিয়া সহ দেশের শীর্ষ সন্ত্রাসীরা। প্রতিদিন গরু পাচার করতে শ্রমিক হিসেবে যারা কাজ করছে সবাই দেশের শীর্ষ সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত বলে জানা গেছে। আর গরু পাচার করতে তারা ভারী অস্ত্র তুলে দিচ্ছে শিশু-কিশোরদের হাতে।গত বছর ৫ আগস্টে সরকার পতন হলে জোয়ারিয়ানালা ও রশিদ নগর এলাকা হয়ে সড়ক পথে বিভিন্ন উপায়ে অবৈধ গরু-মহিষ পাচারে পাচারকারী পরিবর্তনও হয়। তবে সুবিধাভোগের ক্ষেত্রে সবাই একসাথে কাজ করছে। আগে আওয়ামী লীগের লোকজন নেতৃত্ব দিতেন আর এখন জামায়াত-বিএনপির লোকেরা দিচ্ছেন।জানা গেছে, সীমান্ত পয়েন্ট হয়ে মিয়ানমার থেকে আসা গরু-মহিষ ও ইয়াবা রামুর কচ্ছপিয়া, উখিয়ার ঘোনা, গর্জনিয়া ইউনিয়নের বড়বিল, ক্যাজরবিল, জোয়ারিয়ানালা ইউনিয়ন, রশিদনগর ইউনিয়নের বিভিন্ন জায়গায় মজুত করে পরবর্তীতে দেশের বিভিন্ন জায়গায় পাচার করা হয়। সীমান্ত এলাকা ঘুরে গবাদি পশু পাচারে সংযুক্ত বেশ কয়েকজনের সাথে সরাসরি কথা হয়। বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ভালোবাসা, কম্বনিয়া, তুমব্রু, বামহাতিরছড়া, ফুলতলী, চাকঢালা, লম্বাশিয়া, ভাল্লুকখাইয়া, দৌছড়ি, বাইশফাঁড়ি, আশারতলী, জামছড়ি এবং রামুর হাজিরপাড়া ও মৌলভীরকাটা দিয়েও চোরাই পথে মিয়ানমারের গরু আসছে।সীমান্ত এলাকার লোকজন জানিয়েছেন, চিহ্নিত ১৫ ব্যক্তির নেতৃত্বে দুই শতাধিক চোরাকারবারি, ইয়াবা ব্যবসায়ী, হুন্ডি, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, ডাকাতি করে। আর এ সব অপকর্মের দুই নায়ক শাহীন ডাকাত ও জামসেদ অন্যতম। ট্রাকযোগে এসব গরু পৌঁছে যাচ্ছে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায়।স্থানীয়দের অভিযোগ, এখানকার কিছু লোকের সহায়তায় বেশিরভাগ টাঙ্গাইল ভোয়াপুরের শাহিন, বি. বাড়িয়ার সেন্টু মিয়া এই দুই জনের গরু পাচারে সহায়তা করছে কচ্ছপিয়ার শাকিল মেম্বার ও জোয়ারিয়ানালার শাকিল নামের একজন।আরও যারা গরু পাচারের গডফাদার হিসেবে নাম শোনা গেছে, তারা হলেন— চাকমারকুলের আবু তাহের, উখিয়ার কিং জয়নাল, ঈদগাঁও এলাকার আমান খুশবু, চকরিয়ার রমজান, বাবুল ও আব্দু রহিম, টাঙ্গাইল ভুঞাপুর এলাকার মোহাম্মদ আলম, হারুন, খোকন, টেকনাফের আমিন, ঘুমধুমের মিজান মাস্টার ও কুমিল্লার মিজান।এসব গরু পাচারকারীদের সহযোগী হিসেবে কাজ করছে জোয়ারিয়ানালার ডালিম, শুক্কুর, শফিকুর রহমান, নুরুল আবছার, রামু চেরাংঘাটা মোশাররফ ও ইউনুস, কাউয়ারখোপের বাবু, খোকন, সুজন, রাকিব, হাসান, বহু মামলার আসামি মোশাররফ, আব্দুল্লাহ, আজিম, সোহেল, যুবদল নেতা জহির, বহু মামলার আসামি রুবেল, হাসান, শানু, ইকবাল, সমন্বয়ক পরিচয়দানকারী শাকিল, রশিদনগর এলাকার ডাকাত সাদ্দাম, ডাকাত মোস্তাক, তৈয়ব উল্লাহ, কৃষকদল নেতা আবছার, শাহাবুদ্দিন, ইসলাম, খরুলিয়া মিজানসহ আরও বেশ কয়েকজন।বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, আগে আলীকদম ও লামা পথে বার্মিজ গরু মিয়ানমার থেকে পাচার হলেও বর্তমানে চোরাই গরু পাচারকারীরা তাদের পথ পাল্টে বেছে নিয়েছে নতুন পথ। বর্তমানে নাইক্ষ্যংছড়ির সদর ও বাইশারী ইউনিয়নের বিভিন্ন পথে অবাধে গরু পাচার করে আসছে।রামুর কচ্ছপিয়া ও গর্জনিয়া এলাকা ও সীমান্তবর্তী উপজেলা নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত অরক্ষিত থাকায় মিয়ানমার থেকে আলীকদম ও নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা দিয়ে প্রতিদিন প্রবেশ করছে শত শত গরু-মহিষ। দুই উপজেলায় এই পাচার চক্রের সাথে জড়িত অনেকেই গত এক বছরে অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন। এ চক্র এতটাই শক্তিশালী যে, তারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপরও হামলা চালাতে পিছপা হয় না। এমনই এক ঘটনায় গত বছরের এপ্রিল মাসে ২৫০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে নাইক্ষ্যংছড়ি ১১ বিজিবি।

স্বাধীন দেশের পরাধীন এক ভূখণ্ড, যেখানে আইন, প্রশাসন, সরকার সব কিছুই ডাকাত শাহীন—
হিন্দি মুভি শোলে সিনেমাটিতে গাব্বার সিং এর একটা ডায়ালগ বেশ জনপ্রিয়তা পায়,বেটা শো যা ন্যাহি তো গাব্বার আ যা য়ে গা! যার বাংলা অর্থ, বাবু ঘুমিয়ে পর নয়ত গাব্বার চলে আসবে।
বাস্তব জীবনে গাব্বার না আসলেও বিগত দেড় দশক ধরে কক্সবাজারের রামুতে গাব্বার সিং এর চেয়েও নিষ্ঠুর মনুষ্যত্বহীন মানুষের আবির্ভাব হয়েছে। যার ভয় দেখিয়ে, নাম শুনিয়ে এলাকার বাচ্চাদের ঘুম পাড়ানো হয়। এতক্ষণ এত উপমা যাকে নিয়ে তিনি বহু মামলার আসামী শীর্ষ ডাকাত শাহীনুর রহমান ওরফে শাহীন ডাকাত। তিনি রামুর গর্জনিয়া ইউনিয়নের মাঝিরকাটার গ্রামের মোঃ ইসলামের পুত্র।তার মায়াবী চেহারা ও সুদর্শন শারীরিক গঠন দেখলে যে কেউ সহজে তার প্রতি বিমোহিত হবে। কিন্তু তার এই সুন্দর অবয়বে লুকিয়ে আছে নৃশংস এবং ভয়ঙ্কর এক দানবীয় চরিত্র। মানুষ তাকে নব্য এরশাদ সিকদার বলেও তুলনা করে।রামু ও নাইক্ষ্যংছড়ির সীমান্ত এলাকা বিশেষ করে গর্জনিয়া, কচ্ছপিয়া, ঈদগড় ও বাইশারীর দেড় লক্ষাধিক মানুষ তার কাছে জিম্মি। দীর্ঘ দেড় দশক ধরে অপ্রতিরোধ্যভাবে চলছে তার রাম রাজত্ব। তিনিই ঐ এলাকার স্বঘোষিত শাসক। টু-শব্দ করার সাহস কারো নাই। মতের বাইরে গেলেই ধরে নিয়ে গিয়ে দেয়া হয় কঠিন শাস্তি। প্রায়শঃই প্রকাশ্যে ভারী অস্ত্র উঁচিয়ে ফিল্মি স্টাইলে এলাকায় সশস্ত্র মহড়া দিয়ে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করে নিজের অবস্থান জানান দেন ডাকাত শাহীন। প্রশাসনের শাসন চলে না এ অঞ্চলে। শাহিনের শাসনে চলে পুরো এলাকা, তার লাইফস্টাইল যেন তামিল সিনেমার বাস্তব কাহিনী। বলা চলে শাহিনের হাতে স্বাধীন দেশের পরাধীন এক ভূখন্ড, যেখানে আইন, প্রশাসন, সরকার সব কিছুই ডাকাত শাহীন।
থানা সূত্রে জানা যায়, ডাকাত শাহীনের বিরুদ্ধে রামু ও নাইক্ষ্যংছড়ি থানায় ডাকাতি, অস্ত্র, মাদক, হত্যা, চোরাচালান সহ মোট ২০ টির অধিক মামলা রয়েছে।
সূত্রে জানা যায়, রামু-কক্সবাজার এবং নাইক্ষ্যংছড়ি এলাকার বিপদগামী যুবক, সাজাপ্রাপ্ত এবং দাগী আসামীদের নিয়ে গঠন করা হয়েছে শাহীন বাহিনী। পাহাড়ে রয়েছে ডাকাত শাহীনের বিশাল অস্ত্র ভাণ্ডার। সেখানে দেয়া হয় তার বাহিনীর কয়েক শত সদস্যদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ, রয়েছে টর্চার রুম, যেখানে প্রতিপক্ষকে ধরে নিয়ে গিয়ে বৈদ্যুতিক শক দেয়া হয়।
স্থানীয় তথ্যসূত্রে জানা যায়, ঈদগড়ের ভয়ংকর ডাকাত কালু, কলিমুল্লাহসহ কয়েকজনের হাত ধরে ধরে শাহীনের অপরাধ জগতের সূত্রপাত। শুরুতে ঈদগড়- ঈদগাঁও সড়কে ডাকাতি করতে গিয়ে আটক হয়ে জেলে যায় শাহীন। পরে জেল থেকে বের হয়ে ২০১২ সালের দিকে নিজেই একটি বাহিনী গঠন করে রামুর ঈদগড়, গর্জনিয়া এবং নাইক্ষ্যংছড়ির রাবার বাগান মালিকদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় শুরু করেন। জোরপূর্বক চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী মো: হারুনের রাবার বাগান সহ একাধিক মালিকের রাবার বাগান  দখল করে নিয়েছে এই গ্রুপটি। পরবর্তী সময়ে বাড়তে থাকে তার অপরাধনামা। প্রকাশ্য দিবালোকে অপহরণ, খুন, চাঁদাবাজি, চোরাচালান, দখলবাজি, লুটতরাজ, এমন কিছু বাকি নেই যা তার নিজস্ব ডাকাত বাহিনী দ্বারা সংগঠিত হয়নি।
পরবর্তীতে ২০১৪ সালের দিকে স্থানীয় সাংসদ ও হুইপ সাইমুম সরওয়ার কমলের সংস্পর্শে আসেন শাহীন। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি, দ্বিগুণ উৎসাহে অপরাধ জগতে নিজের শক্ত অবস্থান পাকাপোক্ত করেন। নিজেকে আওয়ামী রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত করেন। যার ফলশ্রুতিতে সাংসদ কমল ডাকাত শাহীনের কাছ থেকে মোটা অংকের অর্থের সুবিধা নিতেন। এদিকে ৫ আগস্ট পটপরিবর্তনের পর শাহীন আরো বেশি বেপরোয়া ও অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, বিগত ২০২২ সালের মাঝামাঝি সময়ে মিয়ানমারে সংঘাত শুরু হলে সীমান্ত দিয়ে এপারে অবৈধভাবে গরু প্রবেশ শুরু হলে চোরাচালান সাম্রাজ্যের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ শাহীনের হাতে চলে যায়। এরপর থেকে সীমান্তে বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের সাথে নিয়মিত দ্বিপাক্ষিক বৈঠক হত শাহীন ও তার গ্রুপের। সাম্প্রতিক সময়ে আরাকান তথা রাখাইন রাজ্য আরাকান আর্মির দখলে চলে গেলে ডাকাত শাহীন আরাকান আর্মির ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হন। তারা সীমান্তের এপারে বাংলাদেশে চোরাচালান ব্যবসার একমাত্র মাধ্যম হিসেবে শাহিনকেই বেছে নেন। যেহেতু শাহীনের বিশাল বাহিনী এবং অস্ত্র ভান্ডার রয়েছে, সেহেতু শাহিনের প্রতিই খুবিই আস্থাশীল আরাকান আর্মি। বর্তমানে শাহিনের মাধ্যমেই আরাকান আর্মি সীমান্তের এপারে অবর্ননীয় চোরাচালান করছে। এসব চোরাচালানের মধ্যে গরু-মহিষ,তার সাথে ভারি অস্ত্র, ইয়াবা,আইস, স্বর্ণের বার, সিগারেট, সুপারী উল্লেখযোগ্য। একই সাথে ডাকাত শাহিন এপার থেকে আরাকান আর্মির যাবতীয় রসদ যোগান দিচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক রাজনৈতিক নেতা জানান, শাহীনের চোরাচালানে কেউ বাধা হয়ে দাড়ালে নিশ্চিত মৃত্যু, চোরাচালানকে কেন্দ্র করে বিগত কয়েক মাসে দশটির মতো হত্যাকান্ড সংঘটিত করেছে ডাকাত শাহীন। শাহীনের হাতে খুনের তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে সর্বদা, জনসম্মুখে করা খুনের তথ্য মানুষ জানলেও লোকচক্ষুর অন্তরালে সংঘটিত  হত্যাকান্ডের পরিসংখ্যান থেকে যাচ্ছে আড়ালে। যুবক, বৃদ্ধ, নারী এমনকি পেটের অনাগত সন্তানও রেহায় পায়নি শাহীনের হাত থেকে।
সূত্র বলছে, চোরাচালান থেকে শাহীনের প্রতিদিনের আয় আনুমানিক ৫০ লক্ষ টাকার অধিক, যার অধিকাংশই তিনি প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তরে বিলি বন্টন করেন। এ কারণে প্রশাসন তার প্রতি এত উদাসীন ও নমনীয়তার মূল কারণ বলে অনুসন্ধানে উঠে এসেছে।
রামু ও নাইক্ষ্যংছড়ির সাংবাদিকরাও ডাকাত শাহীনের ভয়ে তটস্থ, নিরাপত্তার কারনে সাংবাদিকরা সংবাদ প্রকাশ করতে ভয় করে তার বিরুদ্ধে। কোন সাংবাদিক তার অসঙ্গতির বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশ করলে পরের দিন তার এবং তার পরিবারের উপর নেমে আসে নির্যাতনের খড়্গ। এমনকি মিথ্যা মামলায় আসামী হয়ে ফেরারী জীবন কাটাতে হচ্ছে অনেক সাংবাদিকে। একটি বস্তুনিষ্ঠ সংবাদের সুত্র ধরে স্থানীয় দুই সাংবাদিক হাফিজুল ইসলাম ও সরওয়ার জাহানকে মিথ্যা মামলার আসামী হতে হয়েছে। এদিকে গত দুই দিন ধরে ডাকাত শাহীনের বিরুদ্ধে নিউজ প্রকাশ করায় দৈনিক কক্সবাজার ৭১ পত্রিকার বান্ডিল গায়েব করে ফেলে এবং রাতে জিল্লু নামের এক সংবাদকর্মী দৈনিক কক্সবাজার ৭১ এর সম্পাদক ও প্রকাশক বেলাল উদ্দিন বেলালকে ডাকাত শাহীন ভাল মানুষ দাবী করে তার বিরুদ্ধে নিউজ না করার জন্য অনেক অনুরোধ করেন । অপরদিকে দৈনিক কক্সবাজার ৭১ এর বার্তা সম্পাদক আবদুর রাজ্জাকের বিরুদ্ধে বুলেটিন টিভি নামক একটি পেইজ থেকে বিভিন্ন রকম মিথ্যা ও ভূয়া অপ প্রচার চালাচ্ছে এবং বিভিন্ন রকম হুমকি ধমকি প্রদান করেন ডাকাত শাহীনের কক্সবাজারে নিয়োজিত কিছু সংবাদকর্মী। শাহীনের চলমান মামলার সংখ্যা অসংখ্য। অথচ তিনি মুক্ত বিহঙ্গের মতো প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে, নিজের সদ্য নির্মিত আলিশান ভবনে অবস্থান করছে, প্রতিদিন চোরাকারবারের মাফিয়াদের সাথে বৈঠকে বসছেন। দলবল সহকারে  বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে উপস্থিত হচ্ছেন, মঞ্চে বক্তব্যও দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কেউ তাকে ধরার সাহস করছে না। গত ৭ এপ্রিল গর্জনিয়া ইসলামীয়া আলিম  মাদ্রাসার দাখিল পরিক্ষার্থী বিদায়ী অনুষ্ঠানে ও ৮ এপ্রিল গর্জনিয়া মাঝিরকাটা কিন্ডারগার্টেন দাখিল মাদ্রাসার বিদায়ী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন। উক্ত বক্তব্য বিজ্ঞাপন আকারে অনলাইনেও প্রচার করা হয়েছে। মূলত আইনশৃংখলা বাহিনীর সাথে বোঝাপড়া রয়েছে বলেই শাহীন দ্বিধাহীনভাবে তার কর্তৃত্ব কায়েম করতে সক্ষম হচ্ছে। ডাকাত শাহীনের ভয়ে প্রাণ সংশয়ে আত্মগোপনে থাকা সাংবাদিক সরওয়ার জাহান জানান, সীমান্তের এপারে আরাকান আর্মির প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে। তিনি জানান, আরাকান আর্মি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য যেমন হুমকি, তেমনি বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের জন্যও চরম বিপজ্জনক। এমতাবস্থায় আরাকান আর্মি নিজেদের যাবতীয় রসদের সম্পূর্নরুপে বাংলাদেশের উপর নির্ভরশীল। আর এই রসদের একমাত্র জোগানদাতা ডাকাত শাহীন। তার রসদ না পৌঁছালে আরাকান আর্মি অনেকটা না খেয়ে মরবে। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের পাশাপাশি বিশেষ করে অকটেন যাচ্ছে ড্রামে ড্রামে। আরাকান আর্মি এসব অকটেন বিভিন্ন অস্ত্র ও বোমা তৈরির কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। এপার থেকে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার বিবিধ পন্য ওপারে যাচ্ছে। সেই সাথে ওখান থেকে এপারে ঢুকছে গরুর সাথে ইয়াবা,আইস, স্বর্ণ,সুপারি ও সিগারেট।আরেক সাংবাদিক আক্ষেপ করে জানান, মৃত্যু ভয় সকলের আছে, এত অভিযোগ এত মামলা থাকার পরও যেখানে প্রশাসন শাহীনের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না, এমন একটি প্রেক্ষাপটে সাংবাদিকরা তার বিরুদ্ধে কলম ধরতে ভীত-শঙ্কিত।

শাহীনের অপরাধনামা:৩ মার্চ ২০২৩ সালে নাইক্ষ্যংছড়ি ইরফান (১৮) কে গুলি করে হত্যা করা হয়। নিহতের পিতা শফিউল্লাহ পুতু’র দাবি প্রতিপক্ষকে ফাঁসানোর জন্য শাহীন তার ছেলেকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে।১৬ ই মার্চ ২০২৪ সালে  বৃহস্পতিবার থিমছড়ি  আহমদুর রহমানের ছেলে আবু তালেব(৩৭) হত্যা করে শাহিী ডাকাত। গরু পাচারে বাধাদান করায় তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।২২ এপ্রিল ২০২৪ সালে সময় স্থানীয় লোকজনের ফসল নষ্ট করে গরু চোরাচালান করছিল শাহীন, এতে বাধাদান করায় ক্ষিপ্ত হয়ে শাহিন ও তার সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের গুলি ও এলোপাতাড়ি দায়ের কোপে গর্জনিয়ার  থোয়াইংগাকাটা ঘোনারপাড়া গ্রামের মৃত নুরুল ইসলামের ছেলে জাফর আলম (৫৫) ও তার ছেলে মোহাম্মদ সেলিম (৩৩) বাবা-ছেলেকে হত্যা করা হয়।৮ মে ২০২৪ সালে রামু উপজেলার পাহাড়ি জনপদ গর্জনিয়ায় আবুল কাশেম (৪০) নামে এক মোটরসাইকেল ড্রাইভারকে গুলি করে হত্যা করা হয়। পরিবারের দাবী নিহত আবুল কাসেমকে শাহীনের নির্দেশে রাত ২টার দিকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে পাশের নারাইম্মাঝিরি পাহাড়ে গুলি করা হয়। আবুল কাসেমকে খুন করে তার প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে এই হত্যাকাণ্ড বলে জানান নিহতের পরিবার।৩ জুন ২৪ সালে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তবর্তী রামুতে বিজিবির মাদক ও চোরাচালানবিরোধী টহল দলের ওপর গুলি চালায় চোরাকারবারিরা। এ ঘটনায় আত্মরক্ষার্থে বিজিবির পাল্টা গুলিতে শাহীন ডাকাতের সেকেন্ড ইন কমান্ডার নেজাম উদ্দিন নামে এক ডাকাত আহত হয়। পরে আহত নেজামকে হাসপাতালে না নিয়ে শাহিনের ঘরের বারান্দায় ফেলে রেখে মৃত্যু নিশ্চিত করে ডাকাত শাহীন। মূলত নেজাম উদ্দীন হত্যায় প্রতিপক্ষকে জড়িয়ে মামলা দিয়ে ফাঁসিয়ে দিতেই শাহিনের এমন চালাকি। পরে নেজামের বাবাকে মোটা অংকের টাকা দিয়ে ম্যানেজ করে বিজিবি, সাংবাদিক এবং নিরীহ লোকজনকে আসামী করে মামলা করান।

ডাকাত শাহীনের অপকর্মের বিরুদ্ধে কথা বলায়  গর্জনিয়ার ইউপি সদস্য মনিরুলকে হত্যার উদ্দেশ্যে নির্মমভাবে হাতুড়ি দিয়ে পিঠিয়ে তার দুই পা ভেঙ্গে দেয়া হয়।
চাঁদার দিতে অস্বীকৃতি জানায় গর্জনিয়ার হেলাল উদ্দিনকে গভীর রাতে অস্ত্রের মুখে তাকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে তার টর্চার সেলে আটকে রেখে বৈদ্যুতিক শক দিয়ে নির্যাতন চালায়।
ডাকাত শাহীনের অপরাধ কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে কথা বলায় থিমছড়ি এলাকার নুর হোসেনের প্রতিবন্ধি ছেলে আবছারকে পায়ে গুলি করে শাহীন গ্রুপ।
নাইক্ষ্যংছড়ির বাইশারী নারিছবনিয়ার মোঃ মকসুদ জানান, ডাকাত শাহীনের অসঙ্গতির বিরুদ্ধে কথা বলায় মকসুদ ও মুফিজকে হত্যার উদ্দেশ্যে তাদের বাড়িতে হামলা চালায় শাহীন ও তার সন্ত্রাস বাহিনী। এসময় মকসুদ ও মুফিজকে না পেয়ে এলোপাতাড়ি গুলি করে এক পর্যায়ে তাদের বাড়ি ঘর জ্বালিয়ে দেয়। এসময় লাথি ও বন্দুক দিয়ে আঘাত করে মাসুদের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীর সাড়ে নয় মাসের অনাগত সন্তানকে হত্যা করে শাহীন ও তার গ্রুপ।
তিনি আরো জানান, শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহীদের সংগ্রহে রয়েছে জার্মানীর তৈরী জিপসি রাইফেলসের মত অত্যাধুনিক ভয়ঙ্কর অস্ত্র। রয়েছে শতাধিক বিদেশী পিস্তল সহ দেশীয় অস্ত্র। গর্জনিয়ার অর্ধ শতাধিক পরিবারের প্রায় দুই শতাধিক মানুষ শাহীনের ভয়ে এলাকা ছাড়া। এই ঘটনাগুলো স্থানীয় প্রশাসনের নিস্ক্রিয়তা  ও সীমান্ত এলাকার নিরাপত্তা ব্যবস্থার দূর্বলতাকে স্পষ্ট করে তুলে ধরে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গর্জনিয়ার এক ইউপি সদস্য জানান, রামু গর্জনিয়া ও নাইক্ষ্যংছড়ি যেন মিয়ানমারের এর একটি অঙ্গ রাজ্যে পরিণত হয়েছে। সীমান্তের যাবতীয় চোরাচালান একহাতে নিয়ন্ত্রণ করছে শাহীন ওরফে ডাকাত শাহীন। বিশেষ করে অস্ত্র, মাদক, বার্মিজ সিগারেট ও গরু-মহিষ। অনেকটা প্রকাশ্য ও বাধাহীনভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হচ্ছে শাহীন। প্রতিদিন অন্ত্যত হাজারের অধিক মিয়ানমারের চোরাই গরু ও শতাধিক সিএনজি যোগে বার্মিজ সিগারেট এর পাশাপাশি পুরোদমে অস্ত্র ও মাদক পাচার করছে এই শাহীন ডাকাত।

ডাকাত শাহিনের অপরাধকর্মের ব্যাপারে জানতে চাইলে নাইক্ষ্যংছড়ি থানার অফিসার ইনচার্জ মাসরুরুল হক অনেকটা ইতস্তত বোধ করেন। চলমান মামলা থাকার পরও ডাকাত শাহিনকে কেন আটক করা হচ্ছে না এমন প্রশ্ন করা হলে ওসি এর কোন সদুত্বর দিতে পারেননি। তবে অপরাধীদের আটকের ব্যাপারে পুলিশ তৎপর রয়েছে বলে জানান।

এদিকে চোরাচালানের ব্যাপারে পুলিশ জিরো টলারেন্স উল্লেখ করে রামু থানার অফিসার ইনচার্জ ইমন কান্তি চৌধুরী জানান, ডাকাত শাহীনের ব্যাপারে খোঁজ রাখা হচ্ছে, ইতিমধ্যে তাকে আটকের ব্যাপারে বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথেও যোগাযোগ করা হয়েছে।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     এই বিভাগের আরও খবর