আজ ১৬ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ৩০শে মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

কক্সবাজারের সুগন্ধার সেই অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে কউক-প্রশাসনের রশি টানাটানি


*শত কোটি টাকার সরকারি জমি গ্রাসে ‘ঈদ-পরিকল্পনা’: সুগন্ধায় দখলবাজদের মহোৎসবের পাঁয়তারা, প্রশাসনের দো’টানায় ক্ষুব্ধ কক্সবাজার বাসী*

*অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে কউকের ‘বাজেট নেই’, উচ্চ আদালতের দোহাই দিয়ে সময় পার করছে জেলা প্রশাসন; হুমকি-ধমকিতে কাবু কর্মকর্তারা*

আবদুর রাজ্জাক, জেলা প্রতিনিধি, কক্সবাজার।।পর্যটন রাজধানী কক্সবাজার শহরের প্রাণকেন্দ্র সুগন্ধা পয়েন্টের শত কোটি টাকা মূল্যের সরকারি জমিতে অবৈধ দখলের মহোৎসব চলছেই। আসন্ন ঈদুল আজহার দীর্ঘ ছুটিকে কাজে লাগিয়ে চিহ্নিত এক ভূমিদস্যু চক্র রাতারাতি সেখানে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণের সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিয়েছে। লোহা, ইট, কংক্রিট, সিমেন্টসহ যাবতীয় নির্মাণ সামগ্রী মজুদ করে দফায় দফায় গোপনে বৈঠকও সেরে ফেলেছে তারা, যেখানে ব্যবসায়ীদের কাছে দোকান বুঝিয়ে দেওয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। অথচ এমন আগ্রাসী তৎপরতা সত্ত্বেও এই বিশাল সরকারি সম্পত্তি উদ্ধারে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন ও কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (কউক) মধ্যে চলছে দায় চাপানোর খেলা, যার সুযোগ নিচ্ছে দখলবাজরা।

*ছুটিকে কাজে লাগাতে যত আয়োজন*
সরকার আসন্ন ঈদুল আজহায় ১০ দিনের দীর্ঘ ছুটি ঘোষণা করেছে। এই সুযোগকে কাজে লাগাতে অত্যন্ত তৎপর হয়ে উঠেছে সুগন্ধার সেই চিহ্নিত দখলবাজ চক্রটি। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ইতিমধ্যে তারা ২২টির মতো দোকানের জন্য নতুন করে লোহার অ্যাঙ্গেল স্থাপন করেছে। লোহা, সিমেন্ট, ইট, চাটারসহ যাবতীয় নির্মাণসামগ্রী মজুত করে ফেলেছে, যা দিয়ে ছুটির ফাঁকা শহরেই রাতারাতি দোকান নির্মাণ সম্পন্ন করার ছক কষা হয়েছে। একাধিক ব্যবসায়ী নাম না প্রকাশের শর্তে জানান, “শুঁটকি মার্কেট ও ড্রাগন মার্কেটের মতো অনেক অবৈধ স্থাপনা নিয়ে লেখালেখি হলেও কিছুই হয়নি। তারাও চাইছে, কোনোমতে মালামাল নিয়ে ব্যবসায়ীরা দোকানে ঢুকে পড়লে আর কেউ কিছু করতে পারবে না।”

জানা যায়, আওয়ামী লীগের নেতা ওবাইদুল হাসানের এই চক্রের নেতৃত্বে রয়েছেন। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর প্রশাসনের ‘নমনীয়তা’কে কাজে লাগিয়ে তিনি টিনের ঘেরাও দিয়ে রাতের আঁধারে সরকারি জমি মাটি ভরাট করেন। এরপর সেখানে শতাধিক দোকানের চক এঁকে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে দোকান বুঝিয়ে দেওয়ার কথা বলে হাতিয়ে নিয়েছেন অন্তত ১০ থেকে ২০ কোটি টাকা। নিজের বাহুবল আরও শক্ত করতে তিনি কয়েকজন সাংবাদিকসহ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকেও তার দলে ভিড়িয়েছেন।

*রহস্যময় ‘সচ্চিদানন্দ সেন গুপ্ত’ ও জালিয়াতির জাল*
এই সরকারি জমি হাতিয়ে নেওয়ার মূল কৌশলের অন্যতম ছিল ‘সচ্চিদানন্দ সেন গুপ্ত’ নামে এক ব্যক্তির বিতর্কিত দাবি। তাকে ঘিরে ‘মৃত’ হওয়ার গুজব ছড়িয়ে পড়লেও, চক্রটি তাকে ‘জীবিত’ প্রমাণ করতে শহরের এক অভিজাত হোটেলে সাংবাদিকদের ডেকে নিয়ে যায়। সেখানে গেঞ্জি পরিহিত এক ব্যক্তি নিজেকে সচ্চিদানন্দ সেন গুপ্ত পরিচয় দিয়ে সরকারি ২.৩০ শতক জমিকে ‘অর্পিত সম্পত্তি’ হিসেবে দাবি করেন। একই সঙ্গে শহরের ৫ তারকা হোটেল ‘স্বপ্নীল সিন্ধু’, মৎস্য গবেষণা কেন্দ্র, ইউনিয়ন হাসপাতালসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ জায়গারও মালিকানা দাবি করেন তিনি। যদিও সেসময় সাংবাদিকদের বহু প্রশ্নের জবাব তিনি এড়িয়ে যান।

*সরকারি রেকর্ড যা বলে*
তবে সরকারি রেকর্ড এই দাবির সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র তুলে ধরে। জেলা প্রশাসনের সাবেক এক কর্মকর্তা জানান, সচ্চিদানন্দ সেন গুপ্ত নামের এই ব্যক্তি যে ২.৩০ শতক জায়গা নিজের অর্পিত জমি বলে প্রচার করছেন, মূলত এটি তার জায়গা নয়। তিনি ‘খালি জায়গা পেয়ে উচ্চ আদালত থেকে রায় এনে’ সরকারি জায়গা দখলের চেষ্টা করছেন। ১৯৯৯ সালের ১৯ এপ্রিল সরকার টেকনাফ থেকে নাজিরার টেক পর্যন্ত এলাকাকে ‘পরিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ)’ হিসেবে ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশ করে। পরবর্তীতে ২০১১ সালে উচ্চ আদালতের এক রায়ে কলাতলীর হোটেল-মোটেল জোনের ৪৯টি প্লট বাতিল করা হয়। এরপর ২০১৮ সালে আরেকটি রায়ে হোটেল-মোটেল জোন এলাকাসহ বিশেষ ২০০০৩ দাগের ৩৯.৭৮ একর জমি সম্পূর্ণভাবে ১ নং খাস খতিয়ানভুক্ত করে সরকার। সচ্চিদানন্দ সেনের দাবিকৃত ২.৩ একর জায়গাটি এই সরকারি ১ নং খাস খতিয়ানেরই অংশ।
কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কউক) এর উপ-নগর পরিকল্পনাবিদ তানভীর হাসান রেজাউল জানান, সচ্চিদানন্দ সেন নামের ওই ব্যক্তির নামীয় ৭৯০০ খতিয়ান জালিয়াতির মাধ্যমে সৃজন পূর্বক ২০২৪ সালের ৩০ জানুয়ারি কউক বরাবর ওই জমি ব্যবহারের জন্য আবেদন করেন। “কিন্তু কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করতে গিয়েই দেখা যায় সব কাগজই ভূয়া এবং নথি জালিয়াতির বিষয়টি স্পষ্ট হয়। এরপর কউক ২০২৪ সালের ১২ জুন জেলা প্রশাসন ও ভূমি অফিসের কাছে চিঠি দিয়ে ভূয়া কাগজপত্র ও সরকারের নথি জালিয়াতি করার কারনে সচ্চিদানন্দ সেনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়।”

তৎকালীন সহকারী কমিশনার (ভূমি) আরিফুল্লাহ নিজামী জানান, “আমাদের স্বাক্ষর জাল করে খতিয়ান সৃজন করে একটি চক্র সরকারি জায়গাটি দখল করতে চেয়েছে। আমি বিষয়টি জানার পর সাথে সাথে সদর মডেল থানায় একটি জিডি করি। ওই ব্যক্তিকে আমি জীবনেও চোখে দেখিনি। তার সাথে জাল-জালিয়াতির একটি বিশাল চক্র জড়িত আছে।”
কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের তৎকালীন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) বিভীষণ কান্তি দাশও নিশ্চিত করেন, “সচ্চিদানন্দ সেনের নামে কোনো খতিয়ান নেই। আমি থাকাকালীন তাঁদের কাগজপত্র ঘেঁটে দেখেছি। সব কাগজেই যথেষ্ট গরমিল রয়েছে। যেখানে ও-ই ব্যাক্তির কোন জায়গায় নেই এবং এই জায়গা মালিক সরকার এবং সচ্চিদানন্দ সেন গুপ্ত নামের উল্লিখিত ব্যক্তির কোন অস্থিত্ব পাওয়া যায় নাই”

*কর্তৃপক্ষের রশি টানাটানি ও হুমকির মুখে কর্মকর্তারা*
এই অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে জেলা প্রশাসন ও কউকের মধ্যে চলছে চরম রশি টানাটানি। দায় যেন নিতে চাইছে না কেউই। একে অপরের ওপর দায় চাপিয়ে দখলবাজদের স্থাপনা নির্মাণের সুযোগ করে দিচ্ছে বলে অভিযোগ সচেতন মহলের।
কউক জানিয়েছে, ওই জায়গা জেলা প্রশাসনের। সদরের সহকারী কমিশনার (ভূমি) শারমিন সুলতানা বলেন, “আমরা চাইলেও উচ্ছেদ করতে পারি না। এছাড়া একটা অভিযান করতে অনেক টাকা খরচ পড়ে। সরকারিভাবে সেই টাকার বরাদ্দ খুবই কম, মাত্র ২০ হাজার টাকা। উপরের অর্ডার আসলে সমন্বিতভাবে অভিযান চালানো হবে।”
অন্যদিকে, জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, সুগন্ধার ওই জায়গায় উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা আছে। সচ্চিদানন্দ সেন গুপ্তের দায়ের করা মামলার প্রেক্ষিতে সরকার পক্ষ সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেছে। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) নিজাম উদ্দিন আহমেদ বলেন, “ঈদের ছুটিতে কাজ করার বিষয়ে জানার পর আদালতকে জানিয়েছি। আমাদের লোকজন পাঠিয়ে খবর নিচ্ছি। ইসিএ এলাকায় স্থাপনা তৈরির কোনো অনুমতি নেই। নতুন করে স্থাপনা তৈরির খবর পেয়েছি। খোঁজ নিয়ে সত্যতা পেলে স্থাপনা গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে।”
তবে অভিযোগ উঠেছে, ওবাইদুল হাসানের সাথে জড়িত অনেকেই সংশ্লিষ্ট দপ্তরে কর্মকর্তাদের ভয়ভীতি দেখাচ্ছেন। এমনকি প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও পুলিশ প্রশাসনের অনেককে পোস্টিং করে দেওয়ার রীতিমতো হুমকিও দিচ্ছেন কক্সবাজার জেলার মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্মলীগের সহ-সভাপতি ওবায়দুল হাসান। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা জানান, ওবায়দুল সিন্ডিকেটের অনেকেই বিভিন্ন দপ্তরের বিরুদ্ধে মিথ্যা রিপোর্ট করারও হুমকি দিচ্ছেন।
এর আগে সুগন্ধার সেই আলোচিত সরকারি জায়গায় অভিযান পরিচালনা করেছিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অভিযানের নেতৃত্ব দেওয়া সহকারী পরিচালক (দুদক) অনিক বড়ুয়া সে সময় সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, একটি চক্র সরকারি জায়গা দখল করে মার্কেট নির্মাণ করে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে এবং এর সত্যতা পাওয়া গেছে।
পর্যটন শহরের প্রাণকেন্দ্রে শত কোটি টাকার সরকারি সম্পত্তি এভাবে জালিয়াতি, হুমকি-ধমকি এবং প্রশাসনের মধ্যকার দো‘টোনার সুযোগ নিয়ে দখলের পাঁয়তারা কক্সবাজারের ভূমি ব্যবস্থাপনার গভীর সংকটকেই চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে। দ্রুত এবং সমন্বিত পদক্ষেপ না নিলে ঈদুল আজহার ছুটির পর সুগন্ধার চেহারা পুরোপুরি পাল্টে যেতে পারে, আর চিরতরে হাতছাড়া হতে পারে সরকারের শত কোটি টাকার জমি। এছাড়াও দখলবাজ মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্মলীগের উক্ত নেতার বিরুদ্ধে জুলাই-আগষ্ট ছাত্র আন্দোলনে নিরীহ ছাত্র-জনতার উপর হামলা-গুলিবর্ষণ, ককটেল নিক্ষেপ, বিএনপির অফিস পুড়িয়ে দেওয়ার বিষয়ে একাধিক মামলা হলেও সে শহরের অলিগলিতে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং অদৃশ্য শক্তির কারণে কক্সবাজার জেলা পুলিশ তাকে গ্রেফতার করতেছে না। এছাড়াও উক্ত ওবাইদুল হাসান এক অডিও রেকর্ডে নিজেকে বিএনপি’র নেতা এবং কক্সবাজার জেলা বিএনপি’র অফিস নিজের অর্থায়নে নির্মান করিয়াছে মর্মে দাবী করেন। উক্ত বিষয়ে জেলা বিএনপি একাধিক সিনিয়র নেতা তার দাবীর বিষয়ে দ্বিমত পোষন করতঃ আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়টি জানান। কিন্তু দীর্ঘদিন অতিবাহিত হওয়ার পর জেলা বিএনপি আশানুরূপ পদক্ষেপ না নেওয়ায় নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক তৃণমূল নেতাকর্মীরা যথেষ্ট অসন্তোষ্ট মর্মে জানান।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     এই বিভাগের আরও খবর