চাটগাঁর সংবাদ ডেস্ক: এক বছর ধরে রক্ষণাবেক্ষণ কাজ হচ্ছে না চট্টগ্রাম নগরীর আখতারুজ্জামান চৌধুরী ফ্লাইওভারে। প্রতিবছর অন্তত একবার সার্বিক পরিস্থিতি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার কথা। কিন্তু সাত বছরে একবারও তা করেনি সিটি করপোরেশন। স্টিল গার্ডার থেকে নাট-বোল্ট খুলে নিচ্ছে দুর্বৃত্তরা। ফ্লাইওভারের নিচে সবুজায়নের জন্য তৈরি করা নিরাপত্তা বেষ্টনীও চুরি হচ্ছে। এতে ঝুঁকিতে আছে মুরাদপুর থেকে লালখানবাজার পর্যন্ত ফ্লাইওভারটি।
সাত বছর আগে ৭০০ কোটি টাকা ব্যয়ে এটি নির্মাণ করে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। এর পর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর করা হয়। সিডিএর সমীক্ষা অনুযায়ী, প্রতিদিন অন্তত ৮০ হাজার গাড়ি চলাচল করে এই ফ্লাইওভার দিয়ে। নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের গাইডলাইনে প্রতিবছর অন্তত একবার নিরীক্ষা করার কথা থাকলেও তা হচ্ছে না। এদিকে ১৫ কোটি টাকা ব্যয়ে সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ হলেও মরে যাচ্ছে ৯০ হাজার গাছ।
গত মঙ্গলবার দুপুরে ২ নম্বর গেটে ফ্লাইওভারে গিয়ে দেখা যায়, বায়েজিদ বোস্তামী সড়ক থেকে জিইসি মোড়ে ওঠানামার লুপ ও র্যাম্পের ২৯টি স্টিল গার্ডারের অনেকগুলো থেকে নাট-বোল্ট খুলে নিয়েছে দুর্বৃত্তরা। এ ছাড়া নগরের শপিং কমপ্লেক্স থেকে ২ নম্বর গেট পর্যন্ত স্টিলের তৈরি নিরাপত্তা বেষ্টনী নিয়ে গেছে। মুরাদপুর অংশের বিভিন্ন এলাকায়ও নিরাপত্তা বেষ্টনী নেই। ২ নম্বর গেট ও নাসিরাবাদ এলাকায়ও নিরাপত্তা বেষ্টনী খুলে নেওয়া হয়েছে। পরিচর্যার অভাবে ফ্লাইওভারের নিচে সড়ক বিভাজকে লাগানো গাছগুলো মরে যাচ্ছে। উপড়ে ফেলা হয়েছে শত শত বাতির পোল। এসব স্থানে মাদকসেবী ও ভাসমান লোকজনের ভিড় থাকে। ফ্লাইওভারের ওপর থেকে বৈদ্যুতিক বাতিগুলো খুলে নিয়ে গেছে। ফ্লাইওভারে জমে আছে ময়লা, আটকে আছে বৃষ্টির পানি।
২ নম্বর গেটের ফুটপাতের দোকানি রহিম মিয়া বলেন, ‘মাদকসেবী ভাসমান কিশোর ও যুবকরা নিরাপত্তা বেষ্টনী খুলে নিয়ে যাচ্ছে। কেউ বাধা দিলে তারা দল বেঁধে তেড়ে আসে। কয়েক দিন আগে ফ্লাইওভারে নাট-বোল্ট খোলার শব্দ পেয়ে লোকজন জড়ো হয়ে তাদের তাড়িয়েছে।’
ফ্লাইওভারের নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার পর এর নিচে সড়ক বিভাজকে সবুজায়ন ও সৌন্দর্যবর্ধনের অংশ হিসেবে নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করা হয়। লাগানো হয় বিভিন্ন প্রজাতির ৯০ হাজার গাছের চারা। মাঝখানে হাঁটাপথ তৈরি করে বসানো হয় টাইলস। গাছগুলোতে পানি ছিটাতে ঝরনা ও সাবমারসিবল পাম্প স্থাপন করা হয়। এ ছাড়া কয়েকশ বিদ্যুতের পোল স্থাপন করা হয়। এসব কাজে সিডিএর ব্যয় হয়েছে ১৫ কোটি টাকা।
আখতারুজ্জামান চৌধুরী ফ্লাইওভারের প্রকল্প পরিচালক ও সিডিএর নির্বাহী প্রকৌশলী মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘গার্ডারের নাট-বোল্ট খুলে নেওয়া হলে অবশ্যই ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতের জন্য একটি গাইডলাইন সিটি করপোরেশনকে দেওয়া হয়েছিল। জাহাজ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে দায়িত্ব দিলেও তারা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে মেরামত করে দিতে পারবে।’
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘মাদকসেবীরা ফ্লাইওভারের নাট-বোল্ট ও গ্রিল চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থা নিতে পুলিশকে চিঠি দেওয়া হবে।’ এদিকে গত ২৮ জুলাই ফ্লাইওভারের নাট-বোল্ট খুলে নেওয়ার বিষয় খতিয়ে দেখতে সিডিএর প্রতিনিধিসহ তিন সদস্যের কমিটি গঠন করেছে সিটি করপোরেশন। তাদের সাত কর্মদিবসের মধ্যে করণীয় নির্ধারণ করে সুপারিশ করতে বলা হয়েছে।
সাত বছরে নিরীক্ষা হয়নি একবারও
২০২২ সালের ৭ জুন ফ্লাইওভারের স্টিল গার্ডারগুলো নিয়মিত মেরামত করা প্রয়োজন জানিয়ে সিটি করপোরেশনের মেয়রের কাছে চিঠি দেন সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী হাসান বিন শামস। সঙ্গে ফ্লাইওভারটির ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান প্রণীত একটি গাইডলাইনও হস্তান্তর করা হয়। গাইডলাইন অনুযায়ী, একজন অভিজ্ঞ পরিদর্শককে দিয়ে বছরে কমপক্ষে একবার নিরীক্ষা করার কথা। এ ছাড়া একজন সেতু পরিদর্শককে দিয়ে প্রতি পাঁচ বছরে একবার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানোর কথা। প্রতি ছয় মাস অন্তর ফ্লাইওভারের ভার বহন ক্ষমতা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে বলা হয়েছে। তবে সাত বছর পার হলেও এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা একবারও করেনি সিটি করপোরেশন।
বিষয়টি স্বীকার করে সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর একবারও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে বলে জানা নেই। এটি সিটি করপোরেশনের প্রকৌশল বিভাগ দেখে।’ তিনি ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে দায়িত্ব নিয়েছিলেন। সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী ফরহাদুল আলম বলেন, ‘আগে অনেকে দায়িত্ব পালন করেছেন। নিরীক্ষা করেছে বলে আমার জানা নেই। এখন গাইডলাইন অনুযায়ী নিরীক্ষা ও মেরামত করা হবে।’
এক বছর ধরে রক্ষণাবেক্ষণ নেই
সিডিএ ও সিটি করপোরেশন সূত্র জানায়, ২০১৪ সালের ১২ নভেম্বর মুরাদপুর থেকে লালখানবাজার পর্যন্ত সাড়ে চার কিলোমিটার দীর্ঘ ফ্লাইওভারটি নির্মাণ শুরু হয়। ৬৯৬ কোটি ৩৪ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত ফ্লাইওভারটিতে যান চলাচল শুরু হয় ২০১৭ সালের ১৬ জুন। ২০১৯ সালের ১ ডিসেম্বর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর করা হয়। একই বছরের ৩১ ডিসেম্বর সৌন্দর্যবর্ধন ও এর রক্ষণাবেক্ষণে ট্রেড ম্যাক্স নামে একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পাঁচ বছরের চুক্তি করে সিটি করপোরেশন। ২০২০ সালে করোনা পরিস্থিতির কারণে এক বছর মেয়াদ বৃদ্ধি করে ২০২৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত চুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হয়।
গত বছরের ৫ আগস্ট দেশের পট পরিবর্তনের পর আদালতের রায়ে সিটি করপোরেশনের মেয়রের পদে বসেন বিএনপি নেতা ডা. শাহাদাত হোসেন। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর ২০২৫ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ট্রেড ম্যাক্সের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করে সিটি করপোরেশন। মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে ইজারার নোটিশ ও চুক্তি বাতিল করায় উচ্চ আদালতে রিট করে ট্রেড ম্যাক্স। আদালত প্রথমে তিন মাস ও পরে ছয় মাসের স্থগিতাদেশ দেন। গত ১৮ জুন সিটি করপোরেশন মেসার্স দেলোয়ার এন্টারপ্রাইজ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করে। আইনি জটিলতা তৈরি হওয়ায় এক বছর ধরে অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে আছে গুরুত্বপূর্ণ এই অবকাঠামো।
জানতে চাইলে ট্রেড ম্যাক্সের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ হেলাল আহমেদ বলেন, ‘আদালতের স্থগিতাদেশ অমান্য করে তারা আরেকটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করেছে। আমাকে কাজ করতে দিচ্ছে না।’
এ প্রসঙ্গে সিটি করপোরেশনের সচিব মোহাম্মদ আশরাফুল আমিন বলেন, ‘আদালতের স্থগিতাদেশ ছিল ২৪ মে পর্যন্ত। আমি স্বাক্ষর করেছি ১৮ জুন। এই সময় আদালতের কোনো স্থগিতাদেশ ছিল না।’