আজ ৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৯শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

বাবার প্রয়াণে শেষ কয়েকটা দিন


জসিম উদ্দিন টিপু

আজ ২৪ জুলাই বাবার ২৭তম মৃত্যুবার্ষিকী। আমার বাবা মরহুম মোহাম্মদ আবুল কাশেম। চট্টগ্রাম জেলাধীন বোয়ালখালী উপজেলার আহলা সাধার পাড়া গ্রামে বাবা ১৯৩০ সালে সাধারণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। আমার দাদার নাম ছিল আবদুল জলিল আর দাদীর নাম ছিল নাজমুন নেছা। বাবা আমৃত্যু শিক্ষকতার সাথে জড়িত ছিলেন। তিনি ২৬ বছর যাবৎ বোয়ালখালী উপজেলাধীন পি সি সেন সারোয়াতলী উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রথমে সহকারী শিক্ষক,সহকারী প্রধান শিক্ষক এবং সবশেষে প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত। এরপর ১৯৭৩ সাল হতে ১৯৭৬ সালের অক্টোবর পর্যন্ত রাউজান উপজেলার নোয়াপাড়া কলেজে প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ ছিলেন।সবশেষে ১৯৭৬ সালের নভেম্বর থেকে ১৯৯২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত পটিয়া উপজেলার ঐতিহ্যবাহী পটিয়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং ১৯৯৩ সালের জানুয়ারি হতে ১৯৯৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত একই প্রতিষ্ঠানে রেক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করে শিক্ষকতার জীবন থেকে অবসর গ্রহণ করেন। বাবা পটিয়ার সূচক্রদন্ডী নিবাসী জমিদার আসাদ আলী মাস্টারের ছেলে মরহুম আহমদ কবির মোক্তারের জ্যেষ্ট জামাতা। শিক্ষকতার জীবন থেকে অবসর গ্রহণ করে বেশি দিন এই ধরণীতে ছিলেন না বাবা। পাঁচ ভাই চার বোন আর মাকে রেখে তিনি ১৯৯৫ সালের ২৪ জুলাই দিবাগত রাতে জিইসি মেডিকেল সেন্টার হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন। অবসরগ্রহণ এর পর মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত পটিয়া আদালত জামে মসজিদের ভাড়া বাসায় বসবাস করতেন। আমি বাবার বড় সন্তান এ জে চৌধুরী কলেজে শিক্ষকতা করতাম,তাই বাসায় থাকতাম। আমার ভাই এ কে এম শামসুদ্দিন লাভলু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে মাস্টার্স পরীক্ষার্থী, এ কে এম মহিউদ্দিন মানিক দিনাজপুর মেডিকেলে কলেজে পড়তো,এ কে এম মঈনুদ্দিন খোকন ও এ কে এম আহসান উদ্দিন পটিয়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়তো। আমাদের আর্থিক অবস্থা তখন স্বাভাবিক ভাবে স্বচ্ছল ছিলো না। বাবা বাসায় ইংরেজি বিষয়ে প্রাইভেট পড়াতেন। কি এক অজানা চিন্তায় বাবা রাত্রে ঘুমাতেন না। আমাকেও একই অবস্থা দেখে বকা দিতেন,এতরাত কেন জেগে রইলাম বলে। কিন্তু আমি বুঝতেই পারিনি বাবার প্রেসার তখন থেকে বেশি ছিলো। এই অবস্থায়ও বাবার প্রাইভেট এর ইনকামই হলো পরিবারের অন্যতম আয়ের উৎস। বাবা সারাজীবন ডায়েরীতে পরিবারের দৈনন্দিন আয়-ব্যয় লিখে রাখতেন। জীবনের শেষ মাস অর্থাৎ জুলাই’১৯৯৫ সালের ১৮ তারিখ পর্যন্ত জীবন চলার হিসাব ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ পাওয়া যায়। ২২ জুলাই শনিবার সকালে আমি পটিয়া সরকারী কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ডিউটি করতে যাচ্ছিলাম, তখন বাবা বললো বাজার করার জন্য কিছু টাকা দিও। আমি বললাম দুপুরে বাসায় আসলে দিবো। সকালে পরীক্ষার ডিউটি শেষ করে দুপুরে বাসায় লাঞ্চ করে আবার বিকালে ডিউটিতে যাবার সময় বাবাকে ১৫০/- টাকা দিলাম। বাবা এই ১৫০/- টাকা নিয়ে একবার হাতে নেয় আবার বালিশের নীচে রাখেন। আমি বুঝতে পারলাম এই টাকাতে বাজার করার জন্য বাবা সন্তুষ্ট ছিলেন না। তাই আমি বললাম বিকালে আসার সময় আরো কিছু টাকা আনবো। বাবার সাথে জীবনের এই শেষ কথা বলে বাবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে পটিয়া কলেজে পরীক্ষার ডিউটিতে চলে আসলাম। ৩.৩০ টার সময় খবর আসলো বাবা ব্রেইন স্ট্রোক করেছেন। বাসায় এসে দেখি, আমার মামারা পটিয়া হাসপাতালের ডাক্তার সালাউদ্দিন সাহেব কে নিয়ে আসলেন,বাবাকে দেখার পর ডাক্তার সালাউদ্দিন সাহেব আমাকে ভৎসনা করলেন,তিনি বললেন, আপনারা শিক্ষিত হয়ে অশিক্ষিতের মতো কাজ করলেন কেমনে? আপনার বাবার প্রেসার হাই হওয়ার কারণে তিনি স্ট্রোক করলেন। ডাক্তার সাহেব এর পরামর্শ মতে সাথে সাথে পটিয়া মেডিকেলে নিয়ে গেলাম,ওখান থেকে সন্ধ্যা সাতটায় জিইসি মোড় মেডিকেল সেন্টারে নিয়ে আসলাম। পটিয়া মেডিকেল থেকে বাবার সহকর্মী ও আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষাগুরু বাবু তপন কুমার সেন বিদায় দিলেন। আসার সময় সাথে পটিয়া আবাহনীর কর্মকর্তা মরহুম আমান উল্লাহ আমান ও মা ছিলেন। মেডিকেল সেন্টার হাসপাতালে নামার সময় বাবা বমি করলেন। তারপর ভর্তি হওয়ার পর ডিউটি ডাক্তার চিকিৎসা করে ওরাডেক্সন ইনজেকশন দিলেন। বাবা কিন্তু সারাক্ষন কথা বলেই যাচ্ছেন যেন ইংরেজি ক্লাশ করাচ্ছেন। রাত নয়টায় বিশেষজ্ঞ ডাক্তার মেডিসিন এর ফারুক সাহেব আসলেন,দেখলেন এবং বললেন রোগীর এটেন্ডেন্ট কে? আমি গেলাম, উনি বললেন,বাবা একটা ভূল হয়ে গেল,এখন আর কিছুই করার নেই। ৭২ ঘন্টা অবজারভেশনে থাকবে,হায়াত মাউত আল্লাহর হাতে, সবাই বাবার জন্য দোয়া করেন। ডাক্তার সাহেব চলে গেলেন। খবর পেয়ে সবাই আসলো, কিন্তু মানিক দিনাজপুর মেডিকেল থেকে তখনো এসে পৌঁছায় নি। ২৩ তারিখ বিকালে মানিক আসলো। আমার মনে হয়, আমার বাবা যেন শুধু মানিকের জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। বাবার বড় সখ ছিলো মানিক কে ডাক্তারি পড়াবেন। তাঁর জীবদ্দশায় সেই আশা পূরণ হয়েছিল। মানিক দিনাজপুর মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়েছিলো। দিনাজপুর থেকে মানিক আসলো। মাকে রাত ১১.৩০ টার দিকে আমার খালাম্মার বাসায় ভাত খাওয়ার জন্য পাঠালাম। আমি দেখলাম বাবা হাসপাতালে বেডের নীচের দিকে চলে আসছে। এটা দেখে ডাক্তারকে ডেকে আনলাম, ডাক্তার দেখে বললেন,তিনি আর নেই। বাবার সাথে দুই রাত থাকার পর ২৪ জুলাই রাত বারোটা ১৫ মিনিটে না ফেরার দেশে বাবা পাড়ি দিলেন। রাত তিনটার দিকে বাবাকে পটিয়া আনলাম। ২৪জুলাই মঙ্গলবার সকাল ১১.০০ টায় পটিয়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে বাবার প্রথম জানাজা, গ্রামের বাড়ি বোয়ালখালী উপজেলাধীন আহলা গ্রামে দ্বিতীয় জানাজা শেষে পারিবারিক কবস্থানে দাফন করা হয়। শেষ জীবন পর্যন্ত বাবা ইংরেজি বিষয়ে প্রাইভেট পড়াতেন। বাবার চিকিৎসার বিষয়ে সব সময় খবর রাখতো লাভলু, হয়তো আমার অবহেলা ছিলো,ডাক্তার বলেছিলেন আরো আগে থেকে প্রেসার বেশি ছিলো। প্রেসারটা যদি চেক দিতে পারতাম সমস্যা টা হতো না। সারাজীবন বাবা সংগ্রাম করেছেন,কষ্ট করেছেন। কিন্তু বাবা সুখটা দেখে যেতে পারলেন না। সবাইকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে, কিন্তু বাবা বড্ড অসময়ে চলে গেলেন। বাবাকে আমি বেশি ভয় পেতাম,কারণ বাসায় দেরিতে আসতাম,ক্লাব আর পার্টি করতাম,বাসায় কম সময় দিতাম,বাবার ভয়ে আস্তে আস্তে মাকে ডেকে বাসায় ঢুকতাম।অনেক কথা তিনি আমাকে বলে গিয়েছেন,যা হয়তো বলা যাবে না।

জসিম উদ্দিন টিপু

অধ‍্যক্ষ- আব্দুল জলিল চৌধুরী কলেজ।

 


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     এই বিভাগের আরও খবর